রুহিয়ার ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢোলারহাট মন্দির - Bengal Hindus
রুহিয়ার ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢোলারহাট মন্দির
রুহিয়া থানার ঢোলারহাট ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত মন্দিরটি ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।
মন্দিরটি সংস্কার না করলে প্রাচীন ঐতিহ্য কালের সাক্ষী হিসেবে ধরে রাখা বড়ই দুস্কর হবে। রুহিয়া থেকে ঠাকুরগাঁও যাওয়ার পথে মাত্র ৫ কি.মি. পরেই ঢোলারহাট শিব মন্দিরটির অবস্থান। এখানে তিনটি মন্দিরের অবস্থান লক্ষণীয়।
একটি শিব মন্দির, একটি দেবি মন্দির ও একটি বিষহরী মন্দির নামে পরিচিত। ঢোলারহাট শিব মন্দিরটি দ্বি-তল বিশিষ্ট। গম্বুজসহ মন্দিরের উচ্চতা প্রায় ৫০ ফুট। মন্দিরটির বাইরের দেয়াল ৮ কোণ বিশিষ্ট, কিন্তু ভেতরে কোনো কোণ নেই। প্রথম তলার পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে ২টি দরজা আছে। দক্ষিণ দরজায় ১৭টি শিব লিঙ্গের প্রতিকৃতি ছিল, যা অধিকাংশই নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া দরজার ওপরে কুকুরের মূর্তি রয়েছে। পূর্ব দরজায় শিবলিঙ্গের কোনো প্রতিকৃতি নেই। কিন্তু বিভিন্ন প্রকার মূর্তি আছে। বাইরের দেয়ালে পলেস্তারার উপরে লতাপাতা ও ফুলের নকশা দেখা যায়।
Also read:
প্রথম তলায় ভেতরে ছাদ গম্বুজের মতো গোলাকৃতি কিন্তু দ্বিতীয় তলার মেঝে সমতল। দ্বিতীয় তলার চারদিকে চারটি ছোট দরজা ও চারটি জানালা আছে। জানালাগুলোতে ত্রিভুজ আকৃতির ইটের জাল বা খোপ রয়েছে। দ্বিতীয় তলার উপরে যে গম্বুজটি ছিল তা ভেঙে গেছে। মন্দিরের ভেতরে বৃহৎ আকৃতির শিবলিঙ্গ আছে, এখানে এখনো পূজা হয়। মন্দিরটির পূর্ব পাশে একটি বড় পুকুর আছে। শিব মন্দির থেকে ৫০ গজ পশ্চিমে বিষহরি মন্দির। এই মন্দিরে মনসা দেবীর পূজা করা হতো।
বর্তমানে মন্দিরটির ধ্বংসস্তুপ ছাড়া আর কিছুই নেই। বিষহরি মন্দিরের সঙ্গে লাগা পশ্চিমে দেবী মন্দির। মন্দিরটিতে দেবী দুর্গার পূজা হতো এবং এখনো পূজা হয়। মন্দিরের ছাদ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। শুধু দাঁড়িয়ে আছে চারপাশের দেয়াল। উত্তর দেয়ালে পলেস্তারায় দুর্গা মূর্তি ছিল যা নষ্ট হয়ে গেছে। মূর্তিটির উপরে এবং পাশে পৌরাণিক কাহিনী চিত্র আছে। দুর্গার পায়ের কাছে বেদীতে শুয়ে আছে শিব মূর্তি। তার নিচে বেদীর দেয়ালে ছয়টি মূর্তি অঙ্কিত আছে এবং মূর্তিগুলোর উপরে নারদ, ইন্দ্র, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব ও নন্দি এই ছয়টি নাম লেখা আছে। মন্দিরটির ভেতরের দিকে উচ্চতায় ২০ ফুট, দৈর্ঘ্য ৩২ ফুট এবং প্রস্থ ১২ ফুট। মন্দিরের পূর্ব পশ্চিমে দুটি ছোট দরজা এবং দক্ষিণে একটি বড় দরজা রয়েছে। দক্ষিণে ৭.৫ ফুট প্রশস্ত একটি বারান্দা ছিল যা এখন সম্পূর্ণ নষ্ট। বারান্দার যে অংশটুকু এখনো দাঁড়িয়ে আছে তাতে নানা ধরনের পৌরাণিক মূর্তি আছে। মন্দির তিনটি সম্পর্কে নানা রকম কাহিনী প্রচলিত।
যেমন মন্দির তৈরির জন্য যত লোক নিয়োগ করা হয়েছিল কাজ সেই অনুপাতে দ্রুত গতিতে হতে থাকে। আবার কখনো নিয়োগকৃত শ্রমিকের চেয়ে অনেক বেশি শ্রমিককে মন্দিরের কাজ করতে দেখা যেত। তাই লোকে বলে স্বয়ং বিশ্বব্রহ্মা নিজ হাতে মন্দির নির্মাণ করেন। অন্য একটি কাহিনী হলো অতীতে এখানে নরবলি দেয়া হতো। তবে মন্দিরে বর্তমান সেবায়েত এই কাহিনী নাকচ করে দিয়ে বলেন, মন্দিরের পার্শ¦বর্তী গ্রামে এক বিধবা নারী ছিল। সম্ভবত চরিত্র নষ্টের আশঙ্কায় বিধবা নারীকে দুর্গার সন্তুষ্টির জন্য দেবী মন্দিরে পূজার উদ্দেশ্যে নিয়ে আসা হয়। দুর্গা সন্তুষ্ট চিত্তে বিধবাকে পূজা হিসেবে গ্রহণ করে ফিরিয়ে দেয়। বিধবা নারীটি অক্ষত শরীরে মন্দির থেকে বের হয়ে আসে। কিন্তু এ ঘটনাটি লোকমুখে নরবলির কাহিনীতে রূপান্তরিত হয়।
জনশ্রæতি আছে, এ মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা গৌরলাল রায় চৌধুরী নামে এক নিঃসন্তান ভূস্বামী। তার বাড়ি মন্দির থেকে দশ গজ পশ্চিমে। বাড়িটি ছোট দুর্গের মতো। বাড়ির চারদিকে ১৫ ফুট উঁচু মাটির প্রাচীর এবং ২৫ ফুট প্রশস্ত গভীর জলাধার দ্বারা সুরক্ষিত। গৌরলাল রায় চৌধুরী মনোরঞ্জনের জন্য নৌকায় করে সেবিকা ও দাসীদের নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। দুর্গটির পশ্চিম উত্তর ও দক্ষিণের প্রাচীরের কিছু অংশ এখনো আছে।
পূর্বদিকের প্রাচীরটি কেটে ফেলা হয়েছে। দুর্গের ইট কিংবা ইমারতের চিহ্ন পাওয়া যায় না। চাষাবাদের সময় বা খননের সময়ও কোনো কিছু পাওয়া যায়নি। তবে এমন ধারণা অস্বাভাবিক নয় যে, এটি কোনো রাজা সাময়িকভাবে দুর্গ হিসেবে ব্যবহার করতেন। মন্দির নির্মাণ কৌশলে মনে হয় এগুলো মোঘল আমলের তৈরি। তবে দেবী মন্দিরের বেদীতে পরিষ্কার বাংলায় যে ছয়টি নাম লেখা আছে তা সংস্কারের পর লিখিত হয়েছিল। মন্দিরটির হারানো গৌরব ফিরিয়ে পাওয়ার দাবি এলাকাবাসীর।
Share করুন