সনাতন একজামা কেন্দ্রিক মতাদর্শ নয় | কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সনাতন একজামা কেন্দ্রিক মতাদর্শ নয় | কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণে বলা হয়েছে, লৌকিক ও বৈদিক বাণীর সাহায্যে একই ইন্দ্রিয়াতীত আত্মস্বরূপ শ্রীভগবানকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে কল্পনা করা হলেও, তিনি এক এবং অদ্বিতীয়।
যথা হিরন্যং বহুধা সমীয়তে
নৃভিঃ ক্রিয়াভির্ব্যবহারবর্ত্মসু।
এবং বচোর্ভিভগবানধোক্ষজো
ব্যাখ্যায়তে লৌকিকবৈদিকৈর্জনৈঃ।।
(শ্রীমদ্ভাগবত:১২.০৪.৩১)
"মানুষ একই স্বর্ণকে অগ্নির সাহায্যে কঙ্কণ, কুণ্ডল, বলয় আদিরূপ প্রদান করে থাকে, তদনুরূপ নিপুণ বিদ্বান লৌকিক ও বৈদিক বাণীর সাহায্যে একই ইন্দ্রিয়াতীত আত্মস্বরূপ শ্রীভগবানকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে উপস্থাপিত করেন।"
Also read:
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সাধারণ মানুষ এই একের বহুরূপে প্রকাশকে সাধারণ দৃষ্টিতে বুঝতে পারে না। তখন তারা বিভ্রান্ত হয়। সনাতন ধর্মেই একমাত্র ধর্ম, যে ধর্মে অনন্ত ঈশ্বরকে অনন্তভাবে উপাসনা করার পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। কেউ যদি মনে করে যে, সে গায়ে যে জামাটা পড়ে আছে, সেই জামাটাই একমাত্র যথাযথ জামা। জগতে আর কোন যথাযথ গায়ের জামা নেই। জামার জগতে এটিই একমাত্র সত্য । তবে এর থেকে অজ্ঞানতাপ্রসূত মূর্খতা আর হয় না। নিজের গায়ের জামার আদলে যদি, কেউ সবাইকে একই প্রকারের জামা পড়াতে চায়, তবে বিড়ম্বনা অশান্তি বাড়বে বই কমবে না। নিজের পছন্দসই আদলের জামা অন্যের গায়ে চাপিয়ে দিতে কেউ যদি প্রচার শুরু করে যে, কারো পছন্দ হোক বা না হোক সবাইকে বাধ্যতামূলক তার মনোনীত নির্দিষ্ট করে দেয়া জামাই পড়তেই হবে। তবে সেই ব্যক্তির থেকে লম্বা ব্যক্তি ইচ্ছা থাকলেও জামাটি পড়তে পারবে না। অথবা তার থেকে খাটো ব্যক্তির শরীরে জামাটি ধুলায় গড়াগড়ি যাবে। ময়লা লেগে বিসদৃশ দেখতে হবে।
পরিণামে জামাটি নষ্ট হবে। তাই এক মাপের জামা সবাইকে পড়ানোর ধারণাটি বর্তমান একবিংশ শতাব্দীতে এসে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। সুস্পষ্টভাবে বলতে গেলে, একেবারেই অযৌক্তিক।একজামা ধারণাটি পৃথিবীর বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তবে একথা অবিসংবাদিত সত্য যে, যতই প্রচেষ্টা করা হোক না কেন একই প্রকারের একই মাপের জামা জগতের সকলকে পড়ানো আদৌও সম্ভবও নয়। এমনকি সামাজিক, অর্থনৈতিক বা রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা নিয়েও সম্ভব নয়। যত দিন যাচ্ছে, বিশ্ব তত বেশী গতিশীল হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে নিজের পছন্দসই একই আদলের জামা জগদ্বাসীকে পড়ানোর ধারণা থেকে মানুষ ধীরেধীরে দূরে সরে যাচ্ছে।
আগামীতে আরও যাবে। বিষয়টি কখনই সম্ভব নয়। হয়তো মধ্যযুগে কিছুটা সম্ভব ছিল, তখন একচ্ছত্র রাজশক্তি ছিল। রাজারা স্বেচ্ছাচারী হয়ে যা খুশি তাই করেছে। জোরজবরদস্তি করে হলেও নিজের মতাদর্শ প্রজাদের উপরে চাপিয়ে দিতে বাধ্য করেছে। প্রজারাও নিরুপায় হয়ে জীবন বাঁচাতে রাজার নির্দিষ্ট করে দেয়া জামা বাধ্য হয়ে গায়ে ধারণ করেছে। কিন্তু জগতে যত বেশি মানবতা, মানবিক অধিকার বা মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত হচ্ছে, তত বেশি এই এক জামা পড়ানোর ধারণা অর্ধচন্দ্র খেয়ে দ্রুত বিদায় নিচ্ছে।সনাতন ধর্ম সেই একজামা পড়ানোর সংকীর্ণ মতাদর্শের অলিগলি নয়। সনাতন ধর্ম হল অনন্ত ভাববৈচিত্রের এক মহাসমুদ্র। ঈশ্বরকে অনন্ত পন্থায় উপাসনা বিষয়টি আমরা শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণেও দেখতে পাই। শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের দশম স্কন্ধে অক্রূর কর্তৃক ভগবানের স্তুতিতে বলা হয়েছে:
ত্বাং যোগিনো যজন্ত্যদ্ধা মহাপুরুষমীশ্বরম্।
সাধ্যাত্মং সাধিভূতং চ সাধিদৈবং চ সাধবঃ৷৷
ত্রয্যা চ বিদ্যয়া কেচিৎ ত্বাং বৈ বৈতানিকা দ্বিজাঃ।
যজন্তে বিততৈর্যজ্ঞৈর্নানারূপামরাখ্যয়া।।
একে ত্বাখিলকর্মাণি সংন্ন্যস্যোপশমং গতাঃ।
জ্ঞানিনো জ্ঞানযজ্ঞেন যজন্তি জ্ঞানবিগ্রহম্।।
অন্যে চ সংস্কৃতাত্মানো বিধিনাভিহিতেন তে।
যজন্তি তন্ময়াস্ত্বাং বৈ বহুমূর্ত্যেকমূর্তিকম্।।
ত্বামেবান্যে শিবোক্তেন মার্গেণ শিবরূপিণম্। বহ্বাচার্যবিভেদেন ভগবন্ সমুপাসতে।।
সর্ব এব যজন্তি ত্বাং সর্বদেবময়েশ্বরম্।
যেঽপ্যন্যদেবতাভক্তা যদ্যপ্যন্যধিয়ঃ প্রভো।।
যথাদ্রিপ্রভবা নদ্যঃ পর্জন্যাপূরিতাঃ প্রভো।
বিশন্তি সর্বতঃ সিন্ধুং তদ্বৎত্বাং গতয়োঽন্ততঃ৷৷
(শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ:১০.৪০.৪-১০)
"সাধু-যোগিগণ সদা আপনাকেই নিজেদের অন্তঃকরণে স্থিত ‘অন্তর্যামী’রূপে, সমস্ত ভূত-ভৌতিক পদার্থে ব্যাপ্ত ‘পরমাত্মা’-রূপে এবং সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি প্রভৃতি দেবমণ্ডলে স্থিত ‘ইষ্টদেবতা’রূপে এবং এসবের সাক্ষী ‘মহাপুরুষ’ এবং ‘নিয়ন্তা ঈশ্বর’রূপে আপনাকে দর্শন করে, আপনারই উপাসনা করে থাকেন।
অনেক কর্মকাণ্ডী ব্রাহ্মণ কর্মমার্গোপদেশক ত্রয়ীবিদ্যা বা বেদের কর্মমূলক উপদেশ অনুসারে বিস্তৃত যজ্ঞাদির অনুষ্ঠানের দ্বারা আপনাকেই 'ইন্দ্র, অগ্নি প্রভৃতি বিভিন্ন দেববাচক নামে তথা বজ্রহস্ত, সপ্তার্চি প্রভৃতি অনেক রূপে অভিহিত করে—আপনারই আরাধনা করেন।
আবার অনেক জ্ঞানমার্গানুসারী সাধক সমস্ত কর্ম সম্যক্ রূপে আপনাতেই ন্যস্ত অর্থাৎ ত্যাগ করে সর্বকর্মসন্ন্যাসের দ্বারা শান্ত-স্বরূপে স্থিত হন। এইভাবে সেই জ্ঞানিগণ জ্ঞানযজ্ঞের দ্বারা জ্ঞানস্বরূপ আপনারই উপাসনা করেন।
বহু শুদ্ধচিত্ত তথা সংস্কারসম্পন্ন বৈষ্ণবগণ আপনারই উপদিষ্ট পাঞ্চরাত্রাদি বিধি অনুসারে ভজননিষ্ঠায় তন্ময়তা প্রাপ্ত হয়ে (ভাবনায় আপনার মধ্যে নিজেদের লীন করে দিয়ে) আপনার বিবিধ রূপ আবার কখনো নারায়ণরূপে এক স্বরূপের পূজা করে থাকেন।
হে ভগবন্! আবার অন্যান্য শৈব সাধকগণ শিবপ্রোক্ত সাধনপদ্ধতি—যার মধ্যে আচার্যভেদে বহুঅবান্তরভেদ বর্তমান –সেগুলির মধ্যে যার যেমন রুচি তদনুযায়ী পথ অবলম্বন করে শিবস্বরূপ আপনারই উপাসনা করেন।
হে প্ৰভু ! যে সকল ব্যক্তি অন্য দেবতাদের ভক্তি করেন এবং তাঁদের আপনার থেকে ভিন্ন বলে মনে করেন, তারা সকলেই প্রকৃতপক্ষে আপনারই আরাধনা করেন, কারণ সব দেবতারূপে আপনিই আছেন এবং সর্বেশ্বরও আপনি।
হে প্ৰভু ! যেমন পর্বত থেকে উৎপন্ন নদীসমূহ বিভিন্ন পথে প্রবাহিত এবং বর্ষার জলে পরিপূর্ণ হয়ে বহুস্রোতা হয়ে নানা শাখায় প্রবাহিত হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত সকল শাখাই ঐ এক সমুদ্রেই গিয়ে মিলিত হয়, সেই প্রকার সকল উপাসনামার্গই শেষ পর্যন্ত আপনাতেই গিয়ে স্থিতি লাভ করে।"
অন্যপোষ্টঃ
শাক্ত, শৈব, সৌর, গাণপত্য এবং বৈষ্ণব এ পঞ্চমতের শক্তি, শিব, সূর্য, গণেশ এবং বিষ্ণু এ পাঞ্চতত্ত্বকে সনাতন ধর্মাবলম্বী মাত্রই বিশ্বাস করতে হবে। কোন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ না করে এ পঞ্চতত্ত্বের মধ্যে যে কোন একটি তত্ত্ব বা রূপকে ইষ্টদেবতা হিসেবে সুনির্দিষ্ট করে সাধন পথে এগিয়ে যেতে হবে। কেউ শৈব হয়ে শিবের আরাধনা করুক বা বৈষ্ণব হয়ে বিষ্ণুর উপাসনা করুক ; কিন্তু তাদের মনে রাখতে হবে হরিহর মূলত এক। বিষ্ণুকে বাদ দিয়ে শিবের আরাধনা করার অর্থ হলো রাবনের মতো অবস্থা হওয়া । রাবন শিব ভক্ত ছিল কিন্তু তিনি বিষ্ণুতত্ত্বের শ্রীরামচন্দ্রের সাথে বৈরীতা করেছেন। পরিনতিতে রাবণের কি অবস্থা হয়েছিল, তা আমরা সকলেই জানি। রাবণের দশ মাথা শিরচ্ছেদ হয়ে তার বিনাশ হয়েছে । এমন ঘটনা বিষ্ণুভক্ত শিবদ্বেষীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই মধ্যযুগের খ্যাতিমান ভক্তকবি শ্রীরামপ্রসাদ সেনের ভাষায় বলতে হয় :
"মন করোনা দ্বেষাদ্বেষি।
যদি হবিরে বৈকুণ্ঠবাসী।।
আমি বেদাগম পুরাণে, করিলাম কত খোঁজ- তালাসি।
ঐ যে কালী,কৃষ্ণ, শিব, রাম, সকল আমার এলোকেশী।।
শিবরূপে ধর শিঙ্গা, কৃষ্ণরূপে বাজাও বাঁশী।
ওমা রামরূপে ধর ধনু, কালীরূপে করে অসী।।
দিগম্বরী দিগম্বর, পীতাম্বর চিরবিলাসী।
শ্মশানবাসিনী বাসী, অযোধ্যা গোকুলনিবাসী।।
ভৈরবী ভৈরব সঙ্গে, শিশু সঙ্গে এক বয়সী।
যেমন অনুজ ধানুকী সঙ্গে জানকী পরম রুপসী।।
প্রসাদ বলে ব্রহ্ম নিরুপণের কথা দেঁতোর হাসি।
আমার ব্রহ্মময়ী সর্বঘটে, পদে গঙ্গা গয়া কাশী।।"
বহুত্বের মধ্যে একত্ব, এটাই হিন্দু ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ। যা বেদ, গীতা এবং বেদান্তসূত্রের চতুর্থসূত্রে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। আমরা যে শুধুমাত্র একজনেরই উপাসনা করি এটা বেদাদি-পৌরাণিক শাস্ত্রগ্রন্থাদিতে তো আছেই, অসংখ্য কবিরাও এ বিষয় নিয়ে লিখেছেন। এই একের মধ্যে বহু এবং বহুর মধ্যে একত্ব এ তত্ত্বের উপরেই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের হিন্দু ধর্ম এবং দর্শন। কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে বিষয়টি উল্টো। তাদের অনেকেরই আছে ধর্মের নামে জোড়জবড়দস্তি। হিন্দুধর্ম বক্তব্যে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, সকলের জন্য এক জামা নয়। ব্যক্তি বিশেষে শারীরিক গঠন এবং রুচিবৈচিত্রের কারণে জামা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে হয়।
"বহুত্বের মধ্যে একত্বই প্রকৃতির নিয়ম, হিন্দুগণ ইহা উপলব্ধি করিয়াছেন। অন্যান্য ধর্ম কতকগুলি নির্দিষ্ট মতবাদ বিধিবদ্ধ করিয়া সমগ্র সমাজকে বলপূর্বক সেগুলি মানাইবার চেষ্টা করে। সমাজের সন্মুখে তাহারা একমাপের জামা রাখিয়া দেয়; জ্যাক, জন, হেনরি প্রভৃতি সকলকেই ঐ এক মাপের জামা পরিতে হইবে। যদি জন বা হেনরির গায়ে না লাগে, তবে তাহাকে জামা না পরিয়া খালি গায়েই থাকিতে হইবে। হিন্দুগণ আবিষ্কার করিয়াছেন-আপেক্ষিককে আশ্রয় করিয়াই নিরপেক্ষ পরম তত্ত্ব চিন্তা উপলব্ধি বা প্রকাশ করা সম্ভব; এবং প্রতিমা ক্রশ বা চন্দ্রকলা প্রতীকমাত্র, আধ্যাত্মিক ভাবপ্রকাশ করিবার অবলম্বন স্বরূপ।" (স্বামী বিবেকানন্দ ২০১৪: ৩৪-৩৫)
এরপরেও অনেকে এক পরমেশ্বরের অনন্ত ভাববৈচিত্রের বিষয়টি সম্যক উপলব্ধি করতে না পেরে বিদ্বেষ করে, যা তাদের মুক্তির পথে অন্তরায় তো বটেই; যুগপৎভাবে সম্প্রদায়ের ঐক্যের পথে অত্যন্ত হানিকর। তাই এই আত্মঘাতী শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব কেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের আগুন থেকে দূরে থাকা প্রয়োজন।
তথ্য সহায়তা:
১. শ্রীমদ্ভাগবত-মহাপুরাণ, গোরক্ষপুর গীতা প্রেস, গোরক্ষপুর: পঞ্চম সংস্করণ ২০০৯
২. স্বামী বিবেকানন্দ, চিকাগো বক্তৃতা, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা: সেপ্টেম্বর ২০১৪
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়