ধর্ম মূর্তিমান হয়ে উঠে মহৎপ্রাণ সাধু চরিত্রের ব্যক্তিগণের সদাচারের প্রভাবে | কুশল বরণ চক্রবর্তী
ধর্ম মূর্তিমান হয়ে উঠে মহৎপ্রাণ সাধু চরিত্রের ব্যক্তিগণের সদাচারের প্রভাবে | কুশল বরণ চক্রবর্তী
কোন মহৎপ্রাণ মানুষ যখন সচল সক্রিয় হয়ে জীবিত অবস্থায় থাকে, তখন তাদের আমরা মূল্যায়ন করি না। মহৎকর্ম মানুষের কর্ম সর্বদাই ব্যতিক্রমী হয়। সেই কর্ম সাধারণ মানুষ সর্বক্ষেত্রে বুঝতে পারে না। যখন বুঝতে পারে না, তখন তাদের নিয়ে হাসিঠাট্টা এবং পরিহাস করে। এই নির্লজ্জ পরিহাসের শতাংশ বাড়তে বাড়তেই তারা তাদের নামে বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে অপদস্ত করার চেষ্টা করে। এতে কখনো তারা সফল হয়, অথবা অপবাদটি অপবাদ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে অপবাদকারী সমাজে নিন্দিত হয়। তবে যিনি সাধু চরিত্রের তার এই মানুষের নিন্দা এবং প্রশংসায় কিছুই আসে যায় না। তিনি সকল কিছুর ঊর্ধ্বে। তিনি পরস্পরবিরুদ্ধ সকল ভাবেই সমদর্শী। শ্রীমদ্ভাগবতের তৃতীয় স্কন্ধে ভগবান কপিল তাঁর জন্মদাত্রী জননী দেবাহূতিকে সাধুর প্রসঙ্গে বলেন:
তিতিক্ষবঃ কারুণিকাঃ সুহৃদঃ সর্বদেহিনাম্।
অজাতশত্রবঃ শান্তাঃ সাধবঃ সাধুভূষণাঃ।।
(শ্রীমদ্ভাগবত:৩.২৫.২১)
" যিনি সহিষ্ণু, করুণায় যার হৃদয় পরিপূর্ণ এবং যিনি সকলের সুহৃদ। যিনি কাউকে শত্রুতার দৃষ্টিতে দেখেন না, সর্বদাই যিনি শান্ত স্বভাবের, যিনি সকল প্রকারের সদগুণের দ্বারা বিভূষিত হয়ে শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে অাচরণ করেন -এ সকল লক্ষণ যাঁর মাঝে অবস্থিত তিনিই সাধু নামে অভিহিত।"
যখন কেউ মহৎপ্রাণ মানুষের প্রতি উদ্ধত আচরণ করে, সেই মহৎপ্রাণগণ ক্ষমা করে দিলেও প্রকৃতির নিয়মে ঈর্ষাকাতর দুষ্ট চরিত্রের ব্যক্তিদের দৈবদণ্ড ভোগ করতে হয়। কখনো সেই দণ্ড দৃশ্যমান থাকে, কখনো থাকে অদৃশ্যমান। ফলশ্রুতিতে সেই ব্যক্তির পাপকর্মের শাস্তির সাথে সাথে পুণ্যকর্মের ফলও বিনষ্ট হয়ে যায় । তার দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায়, হিরণ্যকশিপু এমন শক্তি প্রাপ্ত হয়েছিলো যে, স্বর্গলোক সহ ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত লোক তিনি পরাভূত করেছিলেন। কিন্তু নিজসন্তান নিষ্পাপ প্রহ্লাদের প্রতি অকারণে দুর্ব্যবহারের ফলশ্রুতিতে তার সকল শক্তি বিনষ্ট হয়ে ভগবান তাঁর সম্মুখে মৃত্যুরূপে উপস্থিত হয়।মহাত্মাগণের প্রতি সামান্যতম দুর্ব্যবহার অসম্মানে মানুষের ইহলোকে এবং পরলোকের কল্যাণ সহ সকল প্রকারের কল্যাণই বিনষ্ট হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে:
আয়ুঃ শ্রিয়ং যশো ধর্মং লোকানাশিষ এব চ ।
হন্তি শ্রেয়াংসি সর্বাণি পুংসো মহদতিক্রমঃ ।।
(শ্রীমদ্ভাগবত: ১০.৪.৪৬)
‘‘যে ব্যক্তি অকারণে কোন মহাত্মার প্রতি অসম্মান করে। ফলশ্রুতিতে সেই ব্যক্তির আয়ু, ঐশ্বর্য, যশ, ধর্ম, বৈষয়িক সুখ এবং ইহলোকে-পরলোকের কল্যাণ সহ সকল কল্যাণই বিনষ্ট হয়ে যায়।"
কুটিলচিত্তের ব্যক্তিরা তাদের নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন প্রকারের মহৎপ্রাণ ব্যক্তিদের নামে অপবাদের রটনা করে। এইব্যক্তিরা যুগে যুগের ছিলো। রামায়ণের যুগ থেকে বর্তমান যুগ সকল তাদের দেখা মেলে। এদের কারণেই আদ্যাশক্তির অংশসম্ভূতা দেবী সীতাকে শ্রীরামচন্দ্রের রাজধর্ম পালনার্থে বনবাসে যেতে হয়েছিলো। তাই বিষ্ণুপুরাণের তৃতীয় অংশে বলা হয়েছে এই ক্রুর কুটিলচিত্তের ব্যক্তিদের সাথে কখনই একত্রে অবস্থান না করতে। জগতে সাধু চরিত্রের ব্যক্তিদের সাথে যদি ক্ষণার্দ্ধকালও সংসর্গ করার সুযোগ ঘটে তবে সেই ক্ষণার্দ্ধকালও সংসর্গ অত্যন্ত কল্যাণকর।
নাসমঞ্জসশীলৈস্তু সহাসীত কদাচন।
সদ্ বৃত্তসন্নিকর্ষো হি ক্ষণাৰ্দ্ধমপি শস্যতে ॥
(বিষ্ণু পুরাণ: ৩.১২. ২১)
"কুটিলচিত্ত মানুষের সাথে কখনই একত্র অবস্থান করবে না। ক্ষণার্দ্ধ কালও সাধু ব্যক্তির সংসর্গ প্রশস্ত।"
ধর্ম মূর্তিমান হয়ে উঠে মহৎপ্রাণ সাধু চরিত্রের ব্যক্তিগণের সদাচারের প্রভাবে। ধর্ম্মের স্বরূপ এবং লক্ষণ প্রকাশিত হয় মহৎপ্রাণ সাধুগণের ব্যবহারে এবং সদাচারের। এই মহৎপ্রাণ ব্যক্তিদের না দেখেও অনেকে দূর হতে তাদের বৃত্তান্ত শুনেই তাকে প্রিয় এবং আপনজন বলে বোধ করে। এ প্রসঙ্গে মহাভারতের অনুশাসন পর্বে বলা হয়েছে:
আচারলক্ষণো ধর্মঃ সন্তশ্চাবিত্রলক্ষণাঃ।
সাধুনাঞ্চ যথার্বৃত্তমেতদাচারলক্ষণম্।।
অপ্যদৃষ্টং শ্রবাদেব পুরুষং ধর্ম্মচারিণম্ ৷
ভূতিকৰ্ম্মাণি কুর্ব্বাণং তং জনাঃ কুৰ্বতে প্ৰিয়ম্।।
(মহাভারত:অনুশাসন পর্ব, ৯১.৯-১০)
"সদাচারই ধর্ম্মের স্বরূপ এবং সচ্চবিত্রই সজ্জনের লক্ষণ। সাধুগণের যে ব্যবহার, তাই সদাচারের লক্ষণ।
মানুষ ধর্মাচরণ করতে থাকলে এবং সম্পদের কার্য চিরদিন করলে, না দেখে দূর হতে বৃত্তান্ত শুনেই তাকে প্রিয় বলে মনে করে।"
একজন সাধু আর সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। একজন আত্মকেন্দ্রিকতা নিয়ে ব্যস্ত এবং বিপরীতে অন্যজন সকলের কল্যাণ চিন্তা নিয়ে ব্যস্ত। গুণী মহৎপ্রাণ ব্যক্তিদের যোগ্য সম্মান আমরা দিতে জানিনা বা পারি না। তাইতো এদেশে মহৎপ্রাণ ব্যক্তিদের জন্ম হলেও, সমাদরের অভাবে তারা সমাজ থেকে হারিয়ে যায়। সমাদৃত হতে হলে হয় তাদের বিদেশফেরত হতে হয়, নয়তো মৃত্যুবরণ করতে হয়। গুণী মহৎপ্রাণ ব্যক্তিদের মৃত্যুতে হুজুগে বাঙালির হুশ আসে।অথচ জীবিতাবস্থায় যদি সেই মহৎপ্রাণ ব্যক্তিদের একটু মূল্যায়ন করা হতো, তাদের কীর্তিকে সমর্থন করা হতো, তবে সেই মহৎপ্রাণের ব্যক্তিগণ আরও উৎসাহিত হতেন। এতে সমাজ সভ্যতার আরও উন্নতি হত। কিন্তু আমরা তা করি না। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। সাধু চরিত্রের বিরল মানুষগুলো অন্যের মিথ্যা ঈর্ষাকাতর অপবাদ সইতে সইতে যখন জগত থেকে একবুক কষ্ট নিয়ে চলে যায়, তখন এই আশেপাশের মানুষদের মধ্যে কয়েজন নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। অবশ্য সকলেই ভুলগুলো বুঝতে পারে না। আমরা দাঁত থাকতে দাতের মর্ম বুঝতে পারি না। যখন মুখ থেকে দাঁতগুলো পরে যায়, তখন আমরা উপলব্ধি করি, দাঁতের প্রয়োজনীয়তা। যখন মহান ব্যক্তিগণ মৃত্যুবরণ করেন, তাদের পাঞ্চভৌতিক নশ্বর দেহ চিতার আগুনে ছায় হয়ে বাতাসে উড়ে যায়। তাই বলা হয়:
"উড়িলে সাধুর ছাই,
তবেই সাধুর গুণ গাই "
মহৎপ্রাণ মানুষগুলোকে সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে তাদের গুণগান করা শুরু করি। হারিয়ে বুঝতে পারি ব্যক্তিটির অবদান এবং জাতির জীবনে তাঁর একান্ত প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু তখন আর কিছুই করার থাকে না, স্মৃতি রোমন্থন, অপরাধবোধে ভোগা এবং পাপকর্মের ফলে মানসিক কষ্ট ছাড়া। জীবনের প্রবাহ তখন অনেক দূর থেরে দূরান্তে ছড়িয়ে যায়। তাকে আর চাইলেও ফিরিয়ে আনা যায় না। এ কারণেই বলা হয়, "ভাবিয়া করিয়ো কাজ, করিয়া ভাবিয়ো না"। তাই সময় থাকতে জীবিত অবস্থাতেই মহৎপ্রাণ ব্যক্তিদের সম্মানিত করা উচিত, মৃত্যুর পরে নয়। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যবশত আমরা দেখেছি, আমাদের অধিকাংশ কীর্তিমান মহৎপ্রাণ ব্যক্তিগণই জীবিত অবস্থায় আশেপাশের মানুষের দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন। তাদের অহেতুক নিন্দা অপবাদে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছেন। কবি, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, স্বেচ্ছাসেবী থেকে আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব সাধুসন্ত কেউ বাদ নেই এই তালিকাটি থেকে। এই জীবিত অবস্থায় অসম্মানিত করে মৃত্যুর পরে ফুল দেয়ার এ তালিকাটি দীর্ঘ। সকল জাতির মধ্যেই এ প্রবণতা দেখা যায়। তবে বাঙালির মধ্যে এ প্রবণতা অত্যন্ত বেশি। বহু জাতির মিশ্রণে বাঙালি একটি শঙ্কর জাতি। তেমনি একটি রহস্যময় আচরণ করা পরশ্রীকাতর আত্মঘাতি জাতি।স্বামী বিবেকানন্দ যোগপন্থা অবলম্বন করে মহাসমাধিতে দেহত্যাগ করে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুলাই বিদেহমুক্তি লাভ করেন। মৃত্যুকালে স্বামী বিবেকানন্দের বয়স হয়েছিলো ৩৯ বছর ৫ মাস ২৪ দিন। গঙ্গার তীরে বেলুড়ের মঠপ্রাঙ্গণে স্বামী বিবেকানন্দের দাহকার্য সমাপ্ত হয় পরের দিন ৫ জুলাই সন্ধ্যা ছ’টায়। স্বামী বিবেকানন্দের শেষকৃত্যে শুরু করতে প্রায় একদিন দেড়ি হয়। কারণ, বালি পৌরসভা শ্মশানের বদলে মঠপ্রাঙ্গণে দাহ করার অনুমতি দিতে আপত্তি জানিয়ে অনুমতি প্রদান করতে গড়িমসি করে। পরবর্তীতে সন্ন্যাসীদের প্রচেষ্টায় অনেক কষ্টে বেলুড়ে গঙ্গার পাড়ে স্বামী বিবেকানন্দের দেহ দাহকার্যের অনুমতি পাওয়া যায়। বেলুড় তখন বালি পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত ছিলো। পরবর্তীতে বালি হাওড়া পৌরসংস্থার সঙ্গে মিশে যাওয়ার পর বেলুড়ও হাওড়া পৌরসংস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, যে বেলুড় মঠে স্বামী বিবেকানন্দকে দাহ করার অনুমতি দিতে গরিমসি করছিলো বালি পৌরসভা; সেই বালি-বেলুড় সহ সম্পূর্ণ এলাকাটি আজ পরিচিত শুধু স্বামী বিবেকানন্দের নামে। বিশ্ব আজ সেই এলাকাটিকে চেনে শুধুই স্বামী বিবেকানন্দ এবং তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের নামে। স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যু পরবর্তীতে বিবিধ প্রকারের দুঃখ এবং লজ্জাজনক ঘটনার বিবরণ পাও যায় উপন্যাসিক শংকরের লেখা 'অচেনা অজানা বিবেকানন্দ' গ্রন্থে। সেই গ্রন্থের কয়েকটি তথ্য উল্লেখ করছি। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ডেথ সার্টিফিকেট পাওয়া গেলেও, বিবেকানন্দের ডেথ সার্টিফিকেট পাওয়া যায়নি। হয়ত বেলুড়ে স্বামী বিবেকানন্দের দেহ দাহকার্যের অনুমতি নিয়ে মঠেত সাথে পৌরসভার মতানৈক্য এর কারণ হতে পারে। বিশ্ববন্দিত পুরুষ সন্ধ্যায় দেহাবসান হয়, কিন্তু পরের দিনের কলকাতার সংবাদপত্রে খবরটা ছাপা হয়নি। স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যুর পরবর্তীতে স্মরণসভার দু'জন হাইকোর্টের বিচারককে সভাপতিত্ব করার অনুরোধ করা হয়েছিল। দু'জনেই নিন্দাসূচক মন্তব্য করে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এদের মধ্যে একজন বলেছিলেন, হিন্দু রাজা দেশ শাসন করলে বিবেকানন্দকে ফাঁসি দেওয়া হত। স্বামী বিবেকানন্দের ছোটভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর স্মৃতিকথায় এব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
স্বামী বিবেকানন্দের সমাধিস্থলে ছোট্ট একটি মন্দির তৈরির জন্য অতি সামান্য অর্থ সংগ্রহ করতেও অনেক কষ্ট হয়। এই কাজটির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে বেলুড় মঠ কর্তৃপক্ষের পুরো বাইশ বছর লেগে গিয়েছিল। মন্দিরের কাজ শুরু হয় জানুয়ারি ১৯০৭, প্রতিষ্ঠাকার্য সম্পন্ন হয় ২ জানুয়ারি ১৯২৪। এ প্রসঙ্গে শংকরের একটি নির্মম উক্তি স্মর্তব্য:
"একটা কঠিন সত্য এইসব প্রশ্নর ভিতর থেকে আজও উঁকি দেয়। এক সময় বিশ্বজোড়া আলোড়ন তুললেও স্বামী বিবেকানন্দকে সম্পূর্ণ গ্রহণ করতে আমরা যথেষ্ট সময় নিয়েছি। যুগনায়ক বিবেকানন্দকে ভারতবন্দিত করে তোলার পিছনে সব চেয়ে বড় অবদান বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের। সন্ন্যাসী-সন্তানরা এই প্রতিষ্ঠানকে একশ বছর ধরে প্রাণবন্ত না রাখলে, স্বামী বিবেকানন্দ আজও এইভাবে স্মরণীয় থাকতেন কিনা সন্দেহ হয়।"
(শংকর ২০১৬: ২৭৯)
স্বামী বিবেকানন্দের অন্তেষ্টিক্রিয়ার সময়ের একটি নিষ্ঠুর ঘটনার বিবরণ শংকরের লেখায় পাওয়া যায়। স্বামী বিবেকানন্দের দেহটিতে যখন অগ্নিসংযোগ করা হয় অল্পক্ষণের মধ্যেই অনুকূল বাতাসের হিল্লোলে শরীরে নিম্ন অর্ধাংশ ভস্মীভূত হয়ে পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তাঁর বুক, মস্তকসহ শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গে অগ্নি সামান্যতম স্পর্শ করে না। জলন্ত অগ্নির মধ্যে তাঁর সেই চিরচেনা জ্যোতির্ময় মুখমণ্ডল আরও জ্যোতির্ময় হয়ে উঠে। চিতাগ্নির কাঠ পুড়ে যাচ্ছে, কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দের শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গে অগ্নি সামান্যতম স্পর্শ করছে না দেখে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের এক গৃহীভক্ত নিষ্ঠুর মর্মান্তিক মন্তব্য করেন।
"এমন সময়ে জানি না কোন্ প্রেরণায় পরমহংসদেবের কোনো এক বিশিষ্ট গৃহীভক্তের মুখ হইতে অত্যন্ত মর্মান্তিক একটি মন্তব্য বাহির হইল। ইহা নিতান্ত কঠোর ও পরিতাপের বিষয় বলিয়া লিপিবদ্ধ করা হইল না। তাহা শ্রবণে সকলেই মর্মাহত হইলেন এবং স্বামীজির সন্ন্যাসী শিষ্য শ্রীনিশ্চয়ানন্দ উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, 'যো কোই স্বামীজিকা শির’পর লাঠি মারেঙ্গে, উস্কো শির লাঠিসে হাম্ তোড়েঙ্গে, যেতনা কাঠ লাগে গাছ তোড়কে হাম্ আভি দেঙ্গে।' এই বলিয়া অদূরবর্তী এক প্রাচীন বৃক্ষে আরোহণ পূর্বক তিনি শাখা ছেদন করিয়া প্রচুর কাষ্ঠ সংগ্রহ করিবার পর জ্বলন্ত চিতার উপর তাহা সাজাইয়া স্বামীজির মুখখানি আবৃত করিয়া দিলেন।"
(শংকর ২০১৬: ২৮৪)
এই নিষ্ঠুর বিষয়গুলো চিন্তা করতে হতবাক হয়ে যেতে হয়। চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে। স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যুর পরে নামকরা পত্রিকাগুলোতে শোকসংবাদ পর্যন্ত ছাপেনি! অথচ আজ বাংলা এবং ভারতবর্ষ ছাপিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ আজ বৈশ্বিক সাম্যবাদী সভায় জাজ্জ্বল্যমান হয়ে আছেন। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী দার্শনিকদের সভায় স্বামী বিবেকানন্দ। মৃত্যুর পরে স্বামী বিবেকানন্দের ভাব আদর্শ আরও শক্তিশালী হয়ে বিশ্বকে সাম্যবাদী একাত্মবাদী চিন্তায় আজ মার্গদর্শন করাচ্ছে। মানবসভ্যতা যতদিন আছে, ততদিনই থাকবে তাঁর অনন্য ভাবপ্রবাহ।
তথ্য সহায়তা: ১.শংকর, অচেনা অজানা বিবেকানন্দ, সাহিত্যম্, কলকাতা, সপ্তবিংশ সংস্করণ ২০১৬
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Share করুন