Translate

গুরুকে অতিস্তুতি করে ভগবান বানানো অনুচিত - কুশল বরণ চক্রবর্তী

গুরুকে অতিস্তুতি করে ভগবান বানানো অনুচিত - কুশল বরণ চক্রবর্তী 

গুরুকে অতিস্তুতি করে ভগবান বানানো অনুচিত - কুশল বরণ চক্রবর্তী,Article,আর্টিক্যাল,আর্টিকেল,নিউজ,news,সনাতন ধর্ম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় জগন্নাথ হলের পার্শ্ববর্তী শিববাড়িতে দেখেছি, কৌপীন পড়া এক সাধু ব্রজানন্দের ছবি পূজিত। মন্দিরের ভিতরে আমি তার শিবরূপের ছবি, মাথার উপরে অনন্তনাগসহ বিষ্ণুরূপের ছবি, কৃষ্ণরূপের ছবি দেখে প্রথমে হতবাক হয়ে যাই। তার শিষ্যরা তাঁকে কৃষ্ণ কল্পরূপে মনে করত। ১৯৭১ সালে স্বয়ং শিবের অবতার ব্রজানন্দ বাবা জীবিত থাকার পরেও শিববাড়ি এবং এর আশেপাশের অসংখ্য সাধারণ হিন্দুকে পাকিস্তানিসেনারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ২৫ মার্চ কালরাত্রে নিহত শহীদ বুদ্ধিজীবী গোবিন্দ চন্দ্র দেব এবং ব্রজানন্দ সাধু পাশাপাশি থাকতেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ব্রজানন্দ বাবা তখন ভারতের ত্রিপুরাতে চলে যান, সম্ভবত আর তিনি শিববাড়িতে আসেননি। তার একটি দোলনা ছিল, তিনি বসে তাতে দোল খেতেন। দোলনাটি এখনও আছে। শিব, বিষ্ণু কৃষ্ণের দেহে ব্রজানন্দ বাবার মুখমণ্ডল বসিয়ে ছবিগুলো এডিট করে তৈরি করেছিলেন নারায়ণগঞ্জ ১ নং রেলগেটে অবস্থিত প্রিন্স স্টুডিওর মালিক অমর ঘোষ। ব্রজানন্দ বাবাকে অবতার বানাতে তিনি বিভিন্ন প্রচেষ্টা করেছিলেন। 


কিছু পেইন্টিং ছবি তৈরি করা হয়, তিনি কৌপীন পরে বসে আছেন, পেছনে শ্রীকৃষ্ণ। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে জানতে পারি, এ ছবিগুলো এঁকেছিলেন বরিশালের শ্রেষ্ঠ শিল্পী জগন্নাথ দে। তৎকালীন সময়ে তাকে ব্যপক অনুরোধ করা হয়, তাই মনে সায় না দিলেও তিনি ছবিগুলো এঁকেছিলেন। ব্রজানন্দ বাবা কিন্তু নিজেকে শিবের সেবক হিসেবে পরিচয় দিতে পারতেন বা হয়ত দিতেন। ছবি দেখে তাকে আমার সহজসরল সাধুই মনে হয়েছ। তাঁকে তো আমি কখনো বাস্তবে দেখিনি, কিন্তু তাঁর ছবি দেখে তাঁকে আমার ভণ্ডসাধু বলে মনে হয়নি। সেই তাঁকেও কিন্তু ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক শিবের অবতার হতে হয়েছে, কৃষ্ণের অবতার হতে হয়েছে শিষ্য অমর ঘোষদের কারণে। অমর ঘোষ গুরুর প্রতি অন্ধ ভালবাসা অথবা ব্যক্তিগত স্বার্থে, গুরুকে নিয়ে এ অবতারের প্রচারণা শুরু করেছিলেন। কিন্তু বিধিবাম, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশের টালমাটাল পরিস্থিতি সকল ভণ্ডুল করে দিয়েছে।১৯৭১ সালে ব্রজানন্দ বাবা এবং তার শিষ্য অমর ঘোষ যদি ভারতে চলে না যেতেন, তবে ঢাকা শহরের সবচেয়ে প্রভাবশালী অবতার রূপে হয়ত আমরা ঢাকাসহ ঘরে ঘরে ব্রজানন্দ বাবাকেই পূজিত হতে দেখতাম। আজকে যেটা আমরা লোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবার ক্ষেত্রে দেখি। ঢাকা শহরের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ঘরে ঘরে আজ যেভাবে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর ছবি পূজিত, ঠিক একইভাবে হয়ত ব্রজানন্দ বাবার ছবিও পূজিত হতে দেখতাম।মনুষ্য গুরুদের অতিরিক্ত স্তুতি করে ভগবানের স্থানে বসানো অশাস্ত্রীয়। গুরুর স্থান গুরুর স্থানে। যেমন পিতামাতার স্থান পিতামাতার স্থানে এবং সর্বোপরি ভগবানের স্থান ভগবানের স্থানে। সকলেরই নিজ নিজ স্থান রয়েছে।একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে গুরু পূজনীয় বটে, কিন্তু সে কখনই ঈশ্বরের সমকক্ষ নয়। তিনিও ঈশ্বরের সৃষ্টি।তাই অতিরিক্ত উৎসাহী হয়ে মনুষ্য গুরুদের ভগবান রূপে কল্পনা করে পূজা করা অনুচিত এবং যুগপৎ অপ্রয়োজনীয়। এ প্রসঙ্গে শাস্ত্রে বলা হয়েছে :


দর্শকঃ পটলশ্চৈব ন স্বয়ং মানুষো গুরুঃ।

মোক্ষো ন জায়তে সত্যং মানুষে গুরুভাবনাৎ ।। 

 যথা ভোক্তরি ভোজ্যং হি স্বর্ণাদিপাত্রকেণ চ। 

দীয়তে চ যথা দেবি তস্মৈ সর্বং সমৰ্পণম্ ॥

(কামাখ্যাতন্ত্র: পঞ্চম পটল,১২-১৩)

 

"প্রকৃতপক্ষে মানুষ স্বয়ং গুরু নহে অর্থাৎ মানব গুরু ব্রহ্মের পথ-প্রদর্শক মাত্র। মানুষকে গুরুরূপে কল্পনা করলে কখনও মোক্ষ প্রাপ্তি হয় না। এটা ধ্রুব সত্য। 

ভোক্তার পক্ষে যেরূপ ভোজ্যই গ্রহণীয় এবং স্বর্ণাদি পাত্রে যেমন ঐ ভোজ্য স্থাপন করা হয় মাত্র, সেরূপ মন্ত্রের সমস্ত কিছুই ব্রহ্মকে অর্পণ করা হয় এবং শিষ্য সেই স্থাপিত পাত্রমাত্র।"


সনতন ধর্ম গুরু পরম্পরায় প্রাপ্ত জ্ঞানের উপরে প্রতিষ্ঠিত।  শাস্ত্রানুযায়ী গুরু স্বয়ং ঈশ্বর। তাঁর প্রতিনিধি মনুষ্যগুরু। সেই মনুষ্য গুরু সদা পূজ্য। কিন্তু সেই মনুষ্য  গুরুকে অচিন্ত্য ভগবানের স্থানে চিন্তা করা অনুচিত।মন্দিরে দেববিগ্রহ পূজিত হয়। দেবতার উপাসনার জন্যই মন্দির তৈরি করা হয়।কিন্তু কোন মন্দিরে যদি দেববিগ্রহাদি পরিত্যাগ করে অতিস্তুতি করে কোন গুরুর ছবি বা মূর্তিকেই পূজা করা হয় তবে বিষয়টি অশাস্ত্রীয় এবং দৃষ্টিকটু। কোন একজন গুরু নামধারী ব্যক্তি, তার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, নাতিপুতিসহ বংশধারার মূর্তি ছবি ইত্যাদি পূজিত হয় তবে তা নামে মন্দির হলেও প্রকৃতপক্ষে মন্দির নয়। সেটি হল সেই গুরু নামধারী  ব্যক্তির পারিবারিক স্মৃতিকেন্দ্র। এমন ব্যক্তিগত পারিবারিক স্মৃতিকেন্দ্রের জন্য সাধারণ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কোন প্রকার সাহায্য সহযোগিতা করা উচিত নয় বলে আমি মনে করি।ব্যক্তিকেন্দ্রিক গুরুবাদী চিন্তা, পারিবারিক ছবি পূজা করানো, শিষ্যদের থেকে নিয়মিত টাকা তোলা, মন্দিরে দেবদেবীদের পূজা না করা, ওঙ্কারের ব্যবহার না করা, গৈরিক রঙ বা ধ্বজা ব্যবহার না করা ইত্যাদি বিবিধ কারণে এ সকল ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বেচ্ছাচারী অশাস্ত্রীয় মতাদর্শে নির্মিত অধিকাংশ সংগঠনই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য খুব একটা কল্যাণকর নয়। 


ব্যক্তিকেন্দ্রিক গুরুবাদীরা দুর্গাপূজা, সরস্বতীপূজা, লক্ষ্মীপূজাসহ বিবিধ পূজা করে গুরু বা গুরুর স্ত্রীর ছবি বা মূর্তিতে। চট্টগ্রামে দেখেছি দুর্গাপূজা হয় একজন নামকরা পুরুষ গুরুর ছবিতে। রথযাত্রার সময় এরা রথে ভগবান জগন্নাথদেবকে বসানোর পরিবর্তে গুরুর ছবি বা মূর্তি বসিয়ে রথযাত্রা মহোৎসব পালন করে। যা সম্পূর্ণভাবে অশাস্ত্রীয়।  শ্রীরামচন্দ্রের জন্মতিথি শ্রীরামনবমী এবং শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি জন্মাষ্টমী তিথিতে এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বেচ্ছাচারী গুরুবাদীরা শ্রীরামচন্দ্র এবং শ্রীকৃষ্ণের পরিবর্তে তাদের গুরুর ছবি বা মূর্তিকেই পূজা করে। শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের জন্মতিথি গুরু পূর্ণিমায় এরা নিজের গুরুকে নিয়ে বা তার পূজাদি নিয়ে এতই ব্যস্ত হয়ে যায় যে তারা ভুলেই যায় যে দিনটি কার জন্মতিথি!এদের এ সকল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা ধীরে ধীরে সনাতন ধর্ম থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। তাই আমি এই সকল ব্যক্তিকেন্দ্রিক অধিকাংশ মতাদর্শের সাথে সহমত নই।কারণ এদের কর্মকাণ্ড সনাতনের ঐক্যের পথে অন্তরায়। এদের দেখলে আমার মনে হয়, এরা সেই ইঁদুরদের কথা বা কাঠঠোকরার কথা। যারা নিজের স্বার্থে আশ্রয়দাতার ঘরকে এবং আশ্রয়দাতা গাছকে ক্ষত-বিক্ষত করে দুর্বল করে তোলে।


কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 

সহকারী অধ্যাপক, 

সংস্কৃত বিভাগ, 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url

আপনাদের ক্লিক এই Website টি সচল রাখার অর্থ যোগাবে।