রণদা প্রসাদ সাহা হত্যা: ৭১-এ হিন্দু হলোকাস্ট? - Susupto Pathak
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রণদা প্রসাদ সাহা হত্যা মামলার রায় দিতে গিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তা চেপে রাখা এক ইতিহাসের স্বীকৃতি মাত্র। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “আরপি সাহা এবং তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহাকে হত্যা করাই মূল উদ্দেশ্য ছিল না। আরপি সাহার জনক্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান, তার নেতৃত্ব, প্রভাব, গ্রহযোগ্যতা এবং মানব হিতৈষীমূলক কাজকে সমূলে ধ্বংস এবং হিন্দু সম্প্রদায়কে ধ্বংস করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। সুতরাং এটি মানবতার বিরুদ্ধে ‘গণহত্যা’র অপরাধ।”’।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই সত্যটি চেপে যাওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে হিন্দুদের উপর বিশেষভাবে এবং পরিকল্পিতভাবে ‘হলোকাস্টের’ ন্যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা চালিয়েছিলো। বাংলাদেশ সেটাকে ‘বাঙালী জাতির উপর নির্মমতা’ বলে সরলীকৃত করেছে। হিন্দুরা বাঙালী তো বটেই, হিন্দু, মুসলমান মিলেই বাঙালী জাতি, কিন্তু যখন পরিকল্পিতভাবে হিন্দু সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার মাস্টার প্লাণ করে ম্যাসাকার চালানো হয়- তাকে স্রেফ ‘বাঙালী জাতি’ করে দেয়াটা উদ্দেশ্যমূলক। এতে মুক্তিযুদ্ধে ধর্মকে চিহ্নত করে গণহত্যার ইতিহাসের প্রকৃত চিত্র বিকৃত হয়ে যায়। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর ইহুদীদের উপর চালানো গণহত্যাকে যদি ‘জার্মান জাতির উপর চালানো গণহত্যা’ বলে চালানো হত তাহলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একটি ধর্ম-সম্প্রদায়কে টার্গেট করে তাদের সমূলে ধ্বংস করার চেষ্টাকে আড়াল করা হত না? রণদা প্রসাদ সাহা হত্যা মামলার রায়ে আদালত সেই রায়ই দিয়েছেন যা মুক্তিযুদ্ধে আড়াল করে আসা একটি সত্য ইতিহাস মাত্র।
Also read:
পাকিস্তান সেনাবাহিনী চেকপোস্ট বসিয়ে লোকজনকে কলেমা জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হত সে মুসলমান কিনা।
মুসলমানদের তারা ছেড়ে দিতো। তারা অভিযানে নেমে কাফেরদের খুঁজত। এই কাফের হিন্দুরাই নাকি মুসলমানদের পাকভূমি পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র করেছিলো ভারতের সহায়তায়। হিন্দু ও আওয়ামী লীগারদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া ও তাদের হত্যা করা হয়েছিলো।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে জানানো হয়েছিলো আওয়ামী লীগাররা মূলত হাফ হিন্দু। এদের ইসলামের প্রতি পূর্ণাঙ্গ ঈমান নেই। তাজউদ্দিন আহমদ একজন হিন্দু, তার প্রকৃত নাম ‘তেজরাত রায়’ ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দুরা জান হাতে নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিলো। ঢাকা শহরের শাঁখারী পট্টিসহ পুরান ঢাকার উপর ২৫ মার্চ তাণ্ডব আর নৃশংসতার পরিমাণ ও ভয়াবহতা দেখে তখনকার মানুষ বুঝেছিলো হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় পাক সেনাবাহিনী কতখানি রোষ মিটিয়েছিলো। অবরুদ্ধ ঢাকাতে পাক বাহিনী সাধারণ মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানীদের স্বাভাবিক জীবন পরিচালনা করতে দিয়েছিলো। কিন্তু সেই অবরুদ্ধ ঢাকাতে কি একটিও হিন্দু পরিবার বসবাস করেছিলো? শরণার্থীদের ৯০ ভাগই ছিলো হিন্দু সম্প্রদায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনী তৈরি করেছিলো এক সময়কার পাকিস্তান আন্দোলনের বীর সেনানীরা। তারা মনে করত পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমান বাঙালীদের বন্ধন ছিন্ন করার জন্য হিন্দুরা ক্ষতিকর। পাকিস্তানে রণদা প্রসাদের মত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ প্রভাবশালী বিত্তবাণ হওয়া ছিলো পাকিস্তান তৈরি করার উদ্দেশ্যের বরখেলাপ।
রণদা প্রসাদ সাহা ১৯৩৮ সালে মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেন কুমুদিনী হাসপাতাল। ঠাকুরমার (দাদী) নামে গড়ে তোলেন মেয়েদের আবাসিক স্কুল ভারতেশ্বরী হোমস। ১৯৪৩ সালে টাঙ্গাইলে কুমুদিনী কলেজ এং ১৯৪৬ সালে মানিকগঞ্জে বাবার নামে দেবেন্দ্র কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এই মানুষটির উপর প্রতিশোধ নিতে মোক্ষম সময়টি বেছে নেয়া হয় মুক্তিযুদ্ধের সময়। রাজাকার মাহবুবুর ছিলো পাকিস্তানের একনিষ্ঠ একজন সেবক। বস্তুত ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ আগ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা সবাই মুসলমানের দেশ পাকিস্তানের উপর অগাধ আস্থা রেখেছিলো। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর একদিন আগ পর্যন্ত তারা কায়দে আজম জিন্নাকে নিজেদের পিতার মত সন্মান করত। তাকে নিয়ে ঢাকার কবিরা কবিতা লিখত। গায়করা ভক্তিভরে গান গাইত।
এই প্রেম মুক্তিযুদ্ধের নৃশংসতায় সাময়িক আঘাতপ্রাপ্ত হলেও মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ ঠিকই পাকিস্তানের প্রতি গভীর প্রেম উছলে দিয়েছে। যে কারণে বাংলাদেশর মানুষ কখনই পাক বাহিনীর কারণে পাকিস্তানকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেনি। ১৯৬৪ সালের হিন্দুদের উপর দ্বিতীয় দফায় সাম্প্রদায়িক আক্রমণ, অতঃপর তাদের সম্পত্তি শত্রুসম্পত্তি ঘোষণায় মুসলমানদের নীরবতাকে মাথায় রাখলে বুঝতে কষ্ট হয় না পাকিস্তানের প্রতি এদেশের মানুষ সব দায় উঠিয়ে নিয়েছিলো কেন। শত্রুসম্পত্তি আইনের জোরে হিন্দু সম্পত্তি দখল, সাম্প্রদায়িক আক্রমণ কখনই বাংলাদেশের সাহিত্যে ফলাও করে উঠে আসেনি। এমন কি মুক্তিযুদ্ধের উপর উপন্যাস-নাটকে হিন্দুদের উপর পাকিস্তানী সেনাদের প্রকাশ্য জিহাদের ইতিহাসও উঠে আসেনি। হিন্দু নারীদের ‘গণিমতের মাল’ ঘোষণা কিছুতে ‘বাঙালী জাতির উপর বর্বরতা’ দিয়ে ঢাকা যাবে না। বেছে বেছে হিন্দুদের উপর নির্মমতা নেমে এসেছিলো বলেই কি এদেশের মানুষ তাদের পাকিপ্রেম ছাড়তে পারেনি? রণদা প্রসাদ সাহার রায়ে আদালতের বক্তব্য সেই প্রশ্নকে আরো উদোম করে দিলো। একদিন না একদিন এদেশে মুক্তিযুদ্ধের আসল ইতিহাস স্বীকৃতি পাবেই।
(Translated by Google)
Killing of Ranada Prasad Saha: Hindu Holocaust in 71?
Suppressing the comments made by the International Criminal Tribunal in the Randa Prasad Saha murder case is just an acknowledgment of history. The tribunal's judgment observed, “The main intention was not to kill RP Saha and his son Bhavani Prasad Saha. Their aim was to destroy RP Sahar's public awareness organization, his leadership, influence, philanthropy and philanthropy and destroy the Hindu community. So it is a crime of 'genocide' against humanity." This fact has been suppressed in the history of Bangladesh's liberation war. During the Liberation War, the Pakistan Army carried out genocide against Hindus specifically and systematically like 'Holocaust'. Bangladesh has simplified it as 'brutality on the Bengali nation'. Hindus are Bengalis, Hindus and Muslims together are Bengali nation, but when the master plan to wipe out the Hindu community is carried out and the massacre is carried out - it is purposeful to make it only 'Bengali nation'. In this, the true picture of the history of genocide is distorted by identifying religion in the war of liberation. If the genocide of the Jews by Hitler's Nazi forces was called a 'genocide of the German nation', wouldn't that cover up the attempt to exterminate a religious community by targeting them in World War II? In the verdict of Ranada Prasad Saha's murder case, the court gave the same verdict which is only a true history that was hidden during the liberation war.
Also read: