হিন্দু গণহত্যার ইতিহাস (গোয়ায় হিন্দু নির্যাতন ৩) | Hindu persecution in Goa 3
ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স (ওপরের ছবি) ছিল সোসাইটি অফ জেসুস (জেসুইট) এর একজন সদস্য। ১৫৪২ সালের ৬ মে ৩৬ বছর বয়সে সে গোয়াতে আসে। জেসুইট রোমান ক্যাথলিক চার্চের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান; এর সদস্যদের জেসুইটস, খ্রিস্টের সৈনিক এবং পোপের পদ সৈনিক বলা হয়।
ফ্রান্সিস জেভিয়ার্সের পূর্বে জেনারেল মিগুয়েল ওয়াজ ১৫৪৩ সালে গোয়া থেকে পর্তুগালের রাজা তৃতীয় জনকে (Joao III) চিঠি লিখে গোয়াতেও স্পেনের মত ইনকুইজিশন প্রতিষ্ঠা করার কথা বলেছিল। কিন্তু সেই সময়ে পর্তুগালের রাজা এবং পোপের মধ্যে দ্বন্দ্বের দরুন সেইটা সম্ভব হয় নাই।
এর ঠিক তিন বছর পরে ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স পুনরায় রাজা তৃতীয় জনকে (Joao III) একই কথা জানায় এবং গোয়া ইনকুইজেশন শুরু করে। প্রাথমিক ভাবে এর মূল উদ্দেশ্য ছিল নও-খ্রিষ্টানদের শাস্তির ভয় দেখিয়ে প্রকৃত খ্রিষ্টান হিসেবে গড়ে তোলা, কিন্তু ক্রমে এর গণ্ডি নও-খৃস্টানদের ছাড়িয়ে হিন্দু, ইহুদীদের, বৌদ্ধ, মুসলিমদের ওপরেও পরে। ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স ১৫৪৫ সালে রোমে পোপ এবং রাজা তৃতীয় জনকে লেখা তার চিঠিতে উল্লেখ করছে:
The Hindus are an unholy race. They are liars and cheats to the very backbone. Their idols are black—as black as black can be— ugly and horrible to look at, smeared with oil and smell in an evil manner.
গোয়া ইনকুইজেশনে হেন দুষ্কর্ম ছিলনা যা করা হত নাঃ
- পোপ পঞ্চম নিকোলাস (ওপরের ছবি) একটি ডিক্রি জারি করে গোয়ার মানুষের উপর জোর করে খ্রিস্টধর্ম চাপিয়ে দেয়।
- খ্রিস্টান যাজকেরা প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় নজরদারি করে বেড়াত।
- যদি তাদের মনে কোনো নওমুসলিমের প্রতি ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ জন্মাত যে সঠিকভাবে খ্রিস্টধর্ম পালন করছে না, সাথে সাথে তাকে ধরে নিয়ে এসে অকথ্য নির্যাতন চালাত তারা ।
- তাদের শাস্তির নামে বন্দিশালায় বন্দি রাখা হত, সেখানে জানালা বা আলো ছিল না।
- গোপনে নিজেদের পূর্ব ধর্ম পালনকারীদের চার্চ গণপ্রহার করত। চার্চ তাদের নখ বা চোখ নষ্ট করে দিত, জিহ্বা উপড়ে ফেলত।
- নিজেদের পূর্ব ধর্ম পালনকারীদের বড় চাকার সাথে বেঁধে গড়িয়ে তাদের শরীরের অস্থি ভেঙ্গে দিত।
- বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিত। চার্চ নারী ও শিশুদের দাস বানিয়েছিল।
- এমনকি জীবন্ত পুড়িয়েও মারা হত।
- পিতামাতার বেঁধে তাদের সামনে তাদের বাচ্চাদের পুড়িয়ে মারানোর ভয় দেখিয়ে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করত । সত্যি অনেক বাচ্চাকে তাদের বাবামার সামনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল।
- ইনকুইজিশন চলাকালীন প্রচুর মন্দির ও দেবতার মূর্তিও ধ্বংস করা হয়। ১৫৬৬ সাল থেকে খ্রিস্টানরা গোয়ার সব বড় মন্দির ধ্বংস করে দিয়েছিল। মিশনারীরা সর্বমোট ২৮০ টি মন্দির ধ্বংস করেছিল ।
- এটি পর্তুগিজদের পক্ষে স্থানীয় সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি উপায় ও ছিল। কারণ এতে শাস্তিগুলির একটি হল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা।
- গোয়াতে তখন অনেক ইহুদী স্বাধীন ভাবে বসবাস এবং ধর্ম পালন করতো। ১৫৬০ থেকে ১৬২৩ এর মধ্যে দোষী সাব্যস্ত করা ১,৫৮২ জন ব্যক্তির মধ্যে ৪৫.২% ছিল ইহুদী।
- ১৮১২ সালে গোয়া ইনকুইজেশন শেষ হলেও পর্তুগিজ খ্রিস্টান সরকার কর্তৃক ভারতীয় হিন্দু ও মুসলমানদের উপর ধর্মীয় বৈষম্য ও অত্যাচার জেন্ডিয়া ট্যাক্সের মতো অন্য রূপে অব্যাহত ছিল। যা জিজিয়া কর এরই অন্যরূপ।
- এটিতে রেকর্ডে দেখা যায় যে কমপক্ষে ৫৭ গোয়ান হিন্দুদের ১৫৬০ সাল থেকে শুরু করে তিনশ বছরের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
- সব ধরণের মুর্তি, ছবি বানানো, ঘরে রাখা ছিল নিষিদ্ধ। সব ধরণের হিন্দু রীতিনীতি, পূজা পাঠ ছিল নিষিদ্ধ, কেউ দাহ কার্য্য, এমনকি ১৬২০ সালে ডিক্রি করা হয় হিন্দু বিবাহ সম্পন্ন হতে পারবে না[1] । মাথায় শিখা, বাড়িতে তুলসী গাছ রাখতে পারবে না।
- অনাথ হিন্দু শিশুদের জোর করে খ্রিস্টান করা হত, হিন্দুরা পালকি বা ঘোড়ায় চড়তে পারতো না।
- নও-খ্রিস্টানদের ১৫ বছরের ভূমি কর মাফ করে দেয়া হত, তাছাড়া সরকারী উচ্চপদে তাদের নিয়োগ দেয়া হত।
- সাধারণ মানুষদের পর্তুগিজ উপাধি ব্যবহার করতে হত।
- ইনকুইজেশন থেকে বাঁচতে দলে দলে হিন্দু অন্য রাজ্যে পালিয়ে যায়। যারা পালিয়ে যেত তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হত।
অনেক ইউরোপীয়কেও শাস্তি পেতে হয়েছিল, যেমন ফরাসী ডাক্তার চার্লস ডেলন। ক্যাথলিক খ্রিস্টান না হবার কারণে তার ৩ বছরের জেল হয় , পরে ফ্রান্সে ফিরে গিয়ে তিনি The Relation of Goan Inquisition নামের একটি বই লেখেন, যেখানে তখনকার ভয়ঙ্কর ঘটনাগুলোর বর্ননা আছে। খ্রিস্টধর্ম প্রচারের নামে বাড়াবাড়ি শুনে রোমের পর্তুগিজ রাষ্ট্রদূত লুরেনকো পাইরেস রাজার প্রতি তার অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। এছাড়া ইংরেজ সরকারও এতে হস্তক্ষেপ করে। এর ফলে ১৮১২ সালে ইনকুইজেশন বন্ধ হয়ে যায়।
এক কথায় বলতে গেলে ১৫৬০-১৮১২, এই ২৫২ বছরে ধর্মের নামে হেন বর্বর কাজ ছিলা না যা ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স এবং তার উত্তরসুরীরা করেছে। এই নারকীয় অত্যাচার শেষ হওয়ার পরে বেশিরভাগ গোয়া ইনকুইজিশন রেকর্ডগুলি ধ্বংস করা হয়েছিল। ১৮১২ সালের ২০ ডিসেম্বর গোয়ার ভাইসরয় পর্তুগালের রাজার কাছে চিঠি লেখে নথি পুড়িয়ে ফেলার জন্য এবং টমাস নরিনহো নামের একজন পাদ্রীকে নিয়োগ দেয়া হয়। সুতরাং বিচারের নামে প্রহসন ঠিক কত জনের উপর মর্মান্তিক নির্যাতন চালানো হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা এবং তাদের নির্ধারিত শাস্তির সম্পূর্ণ জানা অসম্ভব।
১৫৫২ সালের ৩ ডিসেম্বর ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স মারা যায়। স্পেনে, অনেক খ্রিস্টান দেশেই তার মৃত্যুদিবস পালন করা হয়। তাকে সমাহিত করা হয় নাই। সেই গোয়ারই Basilica of Bom Jesus in Goa তে তার মরদেহ একটি রূপার ক্যাস্কেটে রাখা আছে। প্রতিদিন হাজার হাজার দেশ-বিদেশের ভক্ত সেখানে আসে, প্রার্থনা করে তার মরদেহের পাশে, তার ক্যাস্কেট ছুঁয়ে। তারা কি জানে, একদিন এই সাধুবেশী শয়তানটাই তাদের পুর্বপুরুষদের জোর করে ধর্মান্তরিত করেছিল, হেন দুষ্কর্ম ছিল না সে করে নাই ধর্ম আর যীশুর দোহায় দিয়ে। ইহাকেই যদি ধর্ম বলে, তাহা হইলে অধর্ম কাহাকে বলিব? নতুন প্রজন্ম কি ভাল এবং মন্দের পার্থক্য করিতে পারিবে না? সময়ের ব্যবধানেই কি শয়তান সাধুতে পরিণত হইবে?
লিখেছেনঃ Dolon Chapa
আরও পড়ুনঃ
হিন্দু গণহত্যার ইতিহাস (পর্ব ১, পর্ব ২)
ফুটনোটগুলি
https://skanda987.files.wordpress.com/2015/10/goa-inquisition.pdf