বাংলায় সুলতানী শাসনামলের মিথ্যাচারঃ সিরাজউদ্দৌলা | Sirajuddaula, the lie of Sultanate rule in Bengal
নবাব সিরাজউদ্দৌলা মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন, তার নামে কি কি তর্ক-বিতর্ক আছে, তিনি দুশ্চরিত্র-মদ্যপ ছিলেন কি না, কিংবা তার জনপ্রিয়তা মৃত্যুর অনেক পরে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় একজন দেশপ্রেমিক শাসকের প্রয়োজনে তৈরি হয়েছিল কি না এইসব তর্কে আমি যাব না। শুধু নিচের কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাকঃ
১) সিরাজউদ্দৌলার দাদা/নানা কি বাঙালি ছিলেন?
উত্তরঃ আলীবর্দী খান/ মির্জা মুহম্মদ আলী (নানা, ওপরের ছবি) এবং হাজি আহমদ (দাদা) ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভূত, সম্পর্কে ভাই।
২) সিরাজউদ্দৌলার বাবা/মা কি বাঙালি ছিলেন?
উত্তরঃ আগের উত্তর অনুযায়ী, তারাও তুর্কি বংশোদ্ভূত ছিলেন।
৩) সিরাজউদ্দৌলা কি বাঙালি ছিলেন?
উত্তরঃ তাহলে একজন তুর্কি বংশোদ্ভূত নবাব কিভাবে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব হবার খেতাব পেতে পারেন? তিনিও তো প্রকৃতপক্ষে জাতিতে একজন তুর্কি ছিলেন, বাঙালি নন। তৎকালীন শাসকদের ভাষা হিসেবে তিনি ফার্সিতে কথা বলতেন। নাট্যকার উৎপল দত্ত পরিহাস করে বলতেন,
“বাংলা নাটকে শাজাহান এবং ঔরংজেব শান্তিপুরী বাংলায় সংলাপ বলে কিন্তু যেই কোনো ইংরেজ অথবা পর্তুগীজ মঞ্চে আসে অমনি শুরু হয়: ‘টুমি হামি, টুমি হামি’!”
দীর্ঘ দিন বাংলা শাসন (বা শোষনের) ফলে বা বাংলায় অবস্থানের কারনে যদি তাকে বাঙ্গালী বলাও হয়, তবে সেই একই যুক্তিতে ইংরেজদেরকে কেন বলা যাবে না? তারাও তো বাংলায় ২০০ বছরের বেশী অবস্থান করেছে। পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের বিভিন্ন কোণে তখনও, এবং আজও কিছু এ্যংলো-ইন্ডিয়ান পরিবার বাসবাস করছে। সেই সময়ে এ্যংলো-ইন্ডিয়ানদের তো বাঙ্গালীর তকমা দেয়া হয় না। সেই হিসেবে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব/শাসক হবে ইংরেজ রাজপরিবার।
শুনতে যতটা খারাপ লাগছে, যুক্তি অনুযায়ী এটা বলতেও আমার ততটাই খারাপই লাগছে। সিরাজউদ্দৌলা মুসলিম ছিল (আলীবর্দী খান ছিলেন শিয়া-মুসলিম) বলেই বাংলার মুসলিমরা তাকেই শেষ স্বাধীন নবাব মেনে নিচ্ছেন, অথচ সেই একই যুক্তি থাকা সত্ত্বেও ককেশিয়ান খ্রিষ্টান ইংরেজদের বলছেন বহিরাগত, এটা কিভাবে মেনে নেয়া যেতে পারে? একজন বহিরাগত শাসক, যতটাই ভাল কাজ করে থাকুননা (সিরাজের ক্ষেত্রে সেইটাও তর্কসাপেক্ষ) কেন, জাতীয়তাবোধের মাপকাঠিতে তিনি কখনই সেই দেশের মাটির সন্তান হতে পারেন না।
বলতে দ্বিধা নেই, একশ্রেণীর ইতিহাসবিদেরা বাংলার মুসলমানদের শুধু খুশী করার জন্যই যে এই ধরণের মিথ্যাচারকে বাংলাদেশের জাতীয় পুস্তকে তুলে দিয়েছেন, এবং কোমলমতি শিশুদের পড়ানো হচ্ছে একটি ইতিহাসিক মিথ্যা। অন্যদিকে তারাই আবার বর্গী নাম দিয়ে ভারতীয় মারাঠাদের আক্রমনকারী হিসেবে উচ্চকন্ঠে প্রচার করতে কুন্ঠিত হন না। সেখানেও প্রশ্ন ওঠে, ভারতের সুদীর্ঘ ইতিহাসে শান্তিপ্রিয় মারাঠাগণ, যারা কোনদিন বাংলায় আক্রমণ চালায় নাই, তারা এই সময়েই বাংলায় এসে পরল। এই বিষয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।
অ্যাডলফ হিটলারের নাৎসিপার্টি ক্ষমতায় থাকার সময় জার্মানদের মধ্যে বিভিন্ন প্রোপাগান্ডা প্রচার করতেন। এক দিন নাকি তারই পার্টির উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা এসে তাকে এমনই এক প্রোপাগান্ডা যে মিথ্যা তা তুলে ধরেন। উত্তরে হিটলার নাকি বলেছিলেন, বেশী বেশী করে মাইকে, পোস্টারে, বক্তৃতায় সবখানে এই মিথ্যাটাই প্রচার কর। একটা সময় জনগণ এই মিথ্যাকেই সত্য বলে মেনে নেবে।
কবির ভাষায় শেষ করছিঃ
- কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে,
- ‘ভাই বলে ডাক যদি দেব গলা টিপে।
- হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা,
- কেরোসিন শিখা বলে, ‘এস মোর দাদা।’
সুতরাং, বাংলার শেষ স্বাধীন রাজার নাম যদি বলতেই হয়, তিনি হবেন গৌড়েশ্বর (বর্তমান বাংলাদেশের চাপাইনবাবগঞ্জ, ভারতের মুর্শীদাবাদ অঞ্চল) লক্ষণসেন, সিরাজউদ্দৌলা নয়।