১৯০০-১৯৪৭ এর অজানা ইতিহাস | Sojasapta 2
১৯৪৭ সালে প্রাচীর ভারত ভূমির খণ্ডিতকরণ কি শুধুই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? ইহা কি ইংরেজ শাসকদের ভারত কে ভবিষ্যতে অবদমিত রাখার একটি কূটনৈতিক চাল? নাকি অন্য কিছু? এই একটি প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে বেশ গভীরে আমাদের প্রবেশ করতে হবে, ফিরে যেতে হবে ১৯০০ সালের গোড়াতে, যখন থেকে একটি সম্প্রদায় বিচক্ষণতার সাথে ভারত ভাগের নীলনকশা তৈরী করছিল, প্রত্যেকটি দৃশ্য সাজিয়ে রাখছিল, প্রত্যেক কুশীলবকে তাদের ভূমিকা সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দেয়া ছিল।
আপনার ঘরেই যদি বিভীষণের বাস হয়, তাহলে সে ঘর যে ভেঙ্গে যাবে, তা আর বলে দিতে হয় না। সেই সময়ের মূল বিভীষণের ভূমিকায় ছিল গান্ধী (দ্যা গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড) এবং নেহেরু। হিন্দু সমাজের ভুল ছিল, এই নেতাদের তারা অন্ধের মতো অনুসরণ করে গেছে যার ফল ভারতবাসী আজ হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে।
আসুন আমরা ভারত বিভাগের অজানা ঘটনাচক্র আলোচনা করি যা কোন ইতিহাসের বই আপনাকে জানাবে না।
সালটা তখন ১৯২০। মুসলিম নেতারা তখন নিজেদের মধ্যে দল পাকাতে শুরু করেছে, উদ্দেশ্য ভারত থেকে মুসলিম ভূমি ছিনিয়ে নেয়া।
এই সময়ে ভারতের বিভিন্ন মসজিদ থেকে কিছু হ্যান্ডবিল বলি করা শুরু হয়ঃ
- কৃষ্ণ তোর গীতা জ্বালাতে হবে (Krishna Teri Geeta Jalani Padegi)
- ১৯ শতকের চরিত্রহীন মহাঋষি (Nineteenth-Century Lustful Maharishi)
- ছিনাল সীতা
আমি ছিনাল সীতা হ্যান্ডবিল এবং তার পরবর্তী প্রভাব নিয়েই আজকে আলোচনা করব। ভারতীয় বৈদিক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যতগুলো নারী চরিত্র রয়েছে, তার মধ্যে সীতা সর্বোত্তম একথা যে কেউ মেনে নিতে বাধ্য। সীতার মতো সংযম, ধর্যশীল, পতিব্রতা নারীর প্রতি কলঙ্ক লেপন তা সীতার শত্রুও করতে পারবে না। বাংলায় কৃত্তিবাস থেকে শুরু করে সমগ্র ভারতে বিভিন্ন ভাষায় রামায়ণের অজস্র অনুবাদ, কিন্তু কোন রামায়ণেই সীতা চরিত্রটিকে কেউ কখনোই কোনভাবেই ছোট করে দেখাতে পারে নাই। সীতা হাজার বছরের ভারতীয় নারীরই প্রতিচ্ছবি, অথচ মসজিদ থেকে যে হ্যান্ডবিল বিলি করা হল তাতে সীতাকে বলা হল ছিনাল, যার অর্থ দাঁড়ায় পতিতা। হ্যান্ডবিলগুলোতে ছিলনা লেখকের নাম, অশ্লীল ভাষায় হিন্দুদেরকে অপমানিত করার সাথে সাথে এর সঙ্গে দেবীদের অশ্লীল ছবিও জুড়ে দেয়া হত।
এর সঙ্গে ১৯২১-২২ সালে দক্ষিণ ভারতের কেরালার কাছে মালাবারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা করে মুসলমানেরা। খেলাফত আন্দোলন নামে এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হাজার হাজার হিন্দুদের নৃশংস ভাবে হত্যা এবং জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়।
তখনকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তার নিজের জবান বন্দীরে বলেছেন, যে প্রায় ১৮০ জন হিন্দুকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করার নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া গেছে এবং প্রকৃত সংখ্যা হাজার হাজার হতে পারে। রোল্যান্ড ই. মিলার ২০০ এবং ২৫০০ এর মধ্যে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত হওয়ার অনুমান করেছেন। এই সময়ের হিন্দু সংগঠন আর্য সমাজের একটি সূত্র অনুযায়ী, এই সময় প্রায় ৬০০ হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছিল এবং ২৫০০ জন জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত হয়েছিল।
প্রতিটি মানুষের, সম্প্রদায়ের সহনশীলতার একটি নির্দিষ্ট সীমা থাকে। ছিনাল সীতা এবং মালবারের দাঙ্গার প্রতিক্রিয়া হিসেবে আর্য সমাজ ১৯২৪ সালের মে মাসে “রঙ্গিলা রাসুল” নামের একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। মূলত উর্দুতে প্রকাশিত (পরে হিন্দিতে অনুবাদ করা হয়) এইটি ছিল মূলত মুহাম্মদের বৈবাহিক জীবনের গীতিকবিতা। পন্ডিত চামুপতি বা চম্পোবতী এটি রচনা করেন। আসুন দেখে নেয়া যাক “রঙ্গিলা রাসুল” সম্পর্কে তখনকার বিখ্যাত অমৃত বাজার পত্রিকা কি বলছে,
“আর. রাসুল” বইটি যেটি মামলার বিষয়বস্তু, এটি একটি ছোট ব্রোশার যা কিছু অজ্ঞাতনামা কিন্তু সুপরিচিত লেখকের লেখা, যিনি নবীর জীবন থেকে উদাহরণ আঁকার চেষ্টা করেছেন। যারা বইটি পড়েছেন তারা জানেন যে সেখানে উপহাস করার কোন চেষ্টা নয় এবং সহজ ও নির্দোষ ভাষায় যে তথ্যগুলো তুলে ধরা হয়েছে তা সম্পূর্ণরূপে ইসলামের মানক লেখকদের লেখার উপর ভিত্তি করে ।
বাবাসাহেব আম্বেদকরের বই থেকে জানা যায়ঃ
Rangila Rasul was written in reply to Sita ka Chinala — a pamphlet written by a Muslim alleging that Sita, wife of Rama, the hero of Ramayana, was a prostitute.
-Dr. Babasaheb Ambedkar Writings and Speeches, Vol 8, By Ministry of Social Justice & Empowerment, Govt. of India (2014), Pakistan: Hindu Alternative to Pakistan, page 169, footnote
মহাত্মা গান্ধী ১৯২৪ সালের জুন মাসে, তার সাপ্তাহিক ইয়ং ইন্ডিয়াতে রঙ্গিলা রসুলকে উল্লেখ করে বলছেঃ
এক বন্ধু আমাকে আর. রসুল নামে একটি উর্দুতে লেখা একটি পুস্তিকা পাঠিয়েছে, লেখকের নাম দেওয়া হয়নি। রঙ্গিলা রসুল শিরোনামটি অত্যন্ত আপত্তিকর। বিষয়বস্তু শিরোনামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমি না দিয়ে পারি না। পাঠকের সূক্ষ্ম বোধের জন্য অপরাধের জন্য কিছু নির্যাস অনুবাদ করুন। আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছি যে আবেগকে জ্বালাতন করা ছাড়া এই ধরনের বই লেখা বা ছাপার উদ্দেশ্য কী হতে পারে। বিশ্বাস এবং এটি একজন হিন্দুর জন্য কোন উপকার করতে পারে না যার নিজের বিশ্বাস সম্পর্কে সন্দেহ থাকতে পারে। একটি অবদান হিসাবে, তাই, ধর্মীয় প্রচারের কাজে, এর কোন মূল্য নেই।
এবার দেখা যাক, সেই একই মহাত্মা গান্ধী মুসলমানদের মসজিদ থেকে হিন্দু ধর্মের বিষয়ে কুৎসা রটনার হ্যান্ডবিল সম্পর্কে কি বলছেঃ
When this matter reached Gandhi, Gandhi made it secondary by saying that "freedom of expression", and said that everyone in India has the right to speak. (অর্থাৎ, হিন্দুদের বিষয়ে অশ্লীল ও মিথ্যা লেখা স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার)
মহাশে রাজপাল (উপরের ছবি)
রঙ্গিলা রাসুলের প্রকাশক ছিলেন মহাশে রাজপাল। পেশায় তিনি ছিলেন লাহোরের একজন সাংবাদিক। ১৯১২ সালে তার প্রকাশনা সংস্থা “রাজপাল অ্যান্ড সন্স” প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি প্রকাশনায় স্বাধীন মত প্রকাশে বিশ্বাসী ছিলেন। তার প্রকাশনা সংস্থা পরিবার পরিকল্পনা, গর্ভনিরোধ ইত্যাদি বিষয় নিয়েও বই প্রকাশ করেছিল যা সেই সময়ের বিচারে অনন্য। রঙ্গিলা রাসুল প্রকাশের পরে মহাশে রাজপালকে পাঞ্জাবের হাইকোর্টে বেশ কিছু আইনী লড়াই লড়তে হয়েছিল। তবে তিনি পরে সে সব থেকে মুক্তি পান।
কিন্তু ১৯২৬-১৯২৯ সালের মধ্যে মহাশে রাজপাল ৩ বার মুসলিম মৌলবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হন। ১৯২৬ সালে প্রথম হত্যা প্রচেষ্টার শিকার হন। যদিও তিনি বেঁচে যান, তিনি ৩ মাস হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তবে, চরমপন্থী মুসলিমানরা রাজপালের জীবন কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যায় এবং ১৯২৭ সালে আরেকটি হত্যার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু আততায়ী একজন ভিন্ন ব্যক্তিকে আক্রমণ করেছিল যাকে সে রাজপাল বলে মনে করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৬ এপ্রিল ১৯২৯ সালে মহাশে রাজপাল লাহোরে তার নিজের প্রকাশনা সংস্থায় ২০ বছর বয়সী ইলাম দ্বীন নামের এক মুসলমানের ছুরিকাঘাতে নিহত হন।
এই ঘটনার ৭ দিন পরে গান্ধী লাহোরে জনসমাবেশে যান, কিন্তু তিনি মহাশে রাজপালের পরিবারের সঙ্গে না দেখা করেন, না এই খুনের বিষয়ে কোন স্টেমেন্ট দেন।
“Mr. Gandhi has been very punctilious in the matter of condemning any and every act of violence and has forced the Congress, much against its will to condemn it. But Mr. Gandhi has never protested against such murders. Not only have the Musalmans not condemned* these outrages but even Mr. Gandhi has never called upon the leading Muslims to condemn them. He has kept silent over them. Such an attitude can be explained only on the ground that Mr. Gandhi was anxious to preserve Hindu-Moslem unity and did not mind the murders of a few Hindus, if it could be achieved by sacrificing their lives (তথ্যঃ ibid, page 157)”
ঠিক সম-সাময়িক কালে আর্য সমাজের আরও কিছু প্রমুখ ব্যক্তিদের হত্যা করে মুসলমানেরা। স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে কে আব্দুল রশিদ নামের এক ব্যক্তি ২৩ ডিসেম্বর, ১৯২৬ তে হত্যা করে। লাল নানাকাচন্ড কে হত্যা করা হয় দিল্লীতে। নথুরামাল শর্মাকে জনৈক আব্দুল কাইয়ুম খুন করে সেপ্টেম্বর, ১৯৩৪ সালে। (তথ্যঃ ibid, page 154)
তার মৃত্যুর প্রায় ৮০ বছর পর, ১৯৯৭ সালে, মহাশে রাজপালকে ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান পাবলিশার্স কর্তৃক দিল্লি বইমেলায় স্বাধীনতার জন্য প্রকাশনা পুরস্কার (মরণোত্তর) এবং ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক প্রকাশক সমিতি থেকে বিশেষ পুরস্কার (মরণোত্তর) ডেয়ার টু পাবলিশ অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়।
ইলাম দ্বীনের (উপরের ছবি) বিচার
কাহিনী শেষ করব আরও কিছু অকপট সত্য ঘটনা দিয়ে। ইলাম দ্বীনের পক্ষে আইনী লড়াই লড়ে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনি ইলাম দ্বীনকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখেন নাই। এমনকি তাকে মাইনর (নাবালক) প্রমাণ করতেও চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীদের বোয়ানে ইলাম দ্বীনের ফাঁসীর শাস্তি হয়।
Two witnesses from the prosecution side claimed that he was guilty. Muhammad Ali Jinnah, then a prominent Indian lawyer, and later the founder of Pakistan, was then sought out to appear in the appeal hearing at the Lahore High Court. [1] Jinnah appealed on the grounds of extenuating circumstances, saying that Ilm Deen was only 19 or 20. He asked for the death sentence to be commuted to imprisonment for life. This contention was rejected by the court.Ilm Deen was convicted and given the death penalty according to the Indian Penal Code, and subsequently executed.
৩১ অক্টোবর ১৯২৯ সালে ফাঁসী কার্যকর হয়। তার জানাজার নামাজে পাকিস্তানের জাতীয় কবি আল্লামা ইকবাল সহ প্রায় ৬ লক্ষ মুসলমান অংশ নিয়েছিল। ইলাম দ্বীনের পিতা আল্লামা ইকবালকে জানাজার নামাজের ইমামতির জন্য অণুরোধ করেন। ইকবাল উত্তর দেন এই বলে, “এই মহান যোদ্ধার জানাজা পড়ানোর তুলনায় আমি একজন পাপী ব্যক্তি”। তিনি লাহোরের হিযবুল আহনাফের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ দিদার আলি শাহকে জানাজা পড়ানোর প্রস্তাব করেন। পরে ওয়াজির খান মসজিদের ইমাম ও সৈয়দ দিদার আলি শাহ জানাজার নামাজ পরিচালনা করে। জনতার প্রচন্ড ভীড়ের কারণে জানাজা তিন দফায় সম্পন্ন করতে হয়। আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল ও সৈয়দ দিদার আলি শাহসহ আরো অনেক খ্যাতনামা পণ্ডিত ইলমুদ্দিনের দাফনে অংশ নেন। এটি ছিল লাহোরের অন্যতম সর্ববৃহৎ জানাজা। তাকে লাহোরের মিয়ানি সাহিব বাহওয়ালপুর রোডের কবরস্থানে দাফন করা হয়। তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য মিয়ানওয়ালি কারাগারে গাজি ইলমুদ্দিন শহীদ মসজিদ নাম একটি মসজিদ তৈরী করা হয়। তৌহিদ জনতা ইলাম দ্বীনকে গাজী এবং শহীদ মর্যাদা দেয়। এইভাবেই একজন খুনী আজ পাকিস্থানের এবং মুসলিম জাতির বীরের মর্যাদা লাভ করেছে।