মধ্যযুগে বাংলায় সূফী এবং তাদের ভূমিকা পর্ব ২ | Sufis and their role in medieval Bengal Part 2
প্রথম পর্বে আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি কিভাবে সুফীদের কর্মকান্ডের সঙ্গে বর্তমান সময়ের জিহাদীদের, তাবলীগ বা ইসলামের দাওয়াতকারীদের গভীর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যদিও সুফীবাদের সঙ্গে এমনকি প্রথাগত মুসলিম সমাজেরও ব্যপক ফারাক রয়েছে। প্রথাগত সুন্নি মুসলিমগণ প্রায়ই তাহাদের শরিয়ত বিরোধী নাম দিয়ে থাকেন। তবে তাহা আমার আলোচনার মুখ্য বিবেচ্য নহে এবং পরবর্তীতে (প্রয়োজনবোধে) ইহা বিস্তর আলোচনা করা যাবে। আমার মুখ্য আলোচ্য বিষয় হিন্দু সমাজকে কিভাবে এই সুফীগনের প্রাচীনকাল হইতে সুচারুরূপে ফেলা ফাঁদে ফেলেছে ইসলামের প্রচারের উদ্দেশ্যে আর হিন্দু সমাজ তাতে ধরা দিয়ে গত ৯০০-১০০০ বছর বা তারও বেশী সময় ধরে ধর্মীয় ও সামাজিক অবক্ষয়ের পথে চলেছে।
একথা জাগতিক সত্য যে অখন্ড ভারতভূমিতে আজ যে ইসলামের অভ্যুত্থান ঘটেছে তাহার সূচনা হয়েছিল এই সুফীদের হাত ধরেই।
তিন শ্রেণীতে সুফীদের আগমনকে ভাগ করা যায়ঃ
১) বখতিয়ার খিলজী পূর্ব সময় (১২০৪ এর আগে) আরব বণিকেদের সঙ্গে ইয়ামেন, মক্কা, তুরস্ক ইত্যাদি স্থান থেকে
২) বখতিয়ার খিলজী সম-সাময়িকঃ বিভিন্ন মুসলিম সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায়
৩) মুঘলদের পৃষ্ঠপোষকতায়ঃ ইসলামিক শাসন সুপ্রিতিষ্ঠিত করার জন্য, ঠিক একই কাজ করেছিল স্পেন দক্ষিণ আমেরিকা জয়ের সময়ে খৃষ্টান মিশনারিদের পাঠিয়ে। স্পেনের উপনিবেশ দক্ষিণ আমেরিকার দেশ থেকে উঠে গেছে অনেক আগেই, কিন্তু খৃষ্টান শাসন যায় নাই।
আমার একজন হিন্দু সহপাঠী আছেন, সাধু-সন্তে তাহার এতোটাই ভক্তি যে রাস্তায় বা কোন গাছের নিচে লাল-কালো-গৌরিক জটাজুটধারী কাউকে দেখলেই তাকে মহাসাধু জ্ঞান করে তাহার নিকটে বসে পরে। তাহার ধারণা যে ব্যক্তি সুখের সংসার ত্যাগ করে এমন কৃচ্ছ সাধনের পথ বেছে নিয়েছেন তিনি মহৎ না হয়ে যেতেই পারেন না।
অখন্ড ভারতভূমিতে প্রবেশের শুরুতেই সুফীদের ভারতবাসীর এই দূর্বলতার কথাটি জানা হয়ে গেছে এবং আল্লাহর অলি, সুফি, পীর, ফকির, দরবেশ, গাউস, কুতুব ও সাধক নামে আজ যারা আমাদের মধ্যে পরিচিত, তাহারা সকলেই এই দূর্বলতাকে কাজে লাগিয়েছেন। প্রাচীন আর্যঋষিদের মতো শ্বেতশুভ্র দাঁড়ি, লম্বাচুল, ধবধবে সাদা চামড়া, অতি উচ্চতা, রঙবেরঙের আলখাল্লা, দু’চারটা জাদুকলা, মিষ্টি ব্যবহার, নোঙরখানায় ফ্রি খাবার, আর ছোটখাট যে কোন সমস্যায় মুশকিল আসান এই বাবাদের প্রতি তৎকালীন (এমনকি বর্তমান সময়ের) হিন্দুরা গুরু ভক্তিতে দলেদলে ঝুঁকে পরেন। আমাকে একবার এক হিন্দু ভদ্রলোক গল্প বলছিলেন, “জানেন ঢাকা দেওয়ানবাগী পীরের দরগায় সরস্বতী পূজোর আয়োজন করা হয়”। আমারও জানা মতে এমন ডজনখানেক পীরের নাম নিতে পারব যারা নিজের দরগাহের পাশেই হিন্দু মন্দির স্থাপন করেছেন প্রাচীনকালেই। ইহা যে নিজেদের অসাম্প্রদায়িক ইমেজ তৈরীর উদ্দেশ্যেই, এবং সনাতনীদের আকৃষ্ট করারই একটি উপদায় তা বলার অপেক্ষা থাকে না।
এখানে প্রশ্ন ওঠে, একজন হিন্দু হিসেবে কি সেই সব পীর, অলিদের, বা দরগাহকে সম্মান দেখানো উচিত? অনেকেই মাজার-মানত করে থাকে ভাল কিছুর আশায়। একজন হিন্দু কি তা করতে পারে? ইহা কি হিন্দুর পরিচয় দেয়?
একটা কেস স্টাডি করা যাক। বেশ কয়েক বছর পূর্বে বাংলাদেশের বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ে মাজারে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেখানে দেখলাম বড় এক হিন্দু পরিবার এসেছে মাজারে সিন্নি দিতে পুরো গাড়ী রিজার্ভ করে। তাদের নাকি বাচ্চা হবার মানত ছিল এই বাবার দরবারে। বিয়ের বেশ কয়েকবছর অতিবাহিত হবার পরেও সেই দম্পতির বাচ্চা হচ্ছিল না। বাবার নামে মানসিত করাতে তাদের বিশ্বাস তারা সন্তানের মুখ দেখতে পাবার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। ভগবান যেখানে বিফল, বাবারা সেখানে সচল !
আসুন, এইবারে এই বাবার পরিচয় যেনে নেয়া যাক। ইনি শাহ সুলতান বলখী মাহিসাওয়ার, ১১ শতকের মুসলিম মিশনারী। জনশ্রুতি আছে তিনি এসেছিলেন আফগানিস্তান হইতে মাছের পিঠে চড়ে। প্রথমে তিনি সন্দ্বীপে ইসলাম প্রচার করেন, পরে পুণ্ড্রনগরে আসেন (৪৪০ হিজরী)।
জনাব মাহিসাওয়ার পুন্ড্রবর্ধন এসে হিন্দু রাজা পরশুরামের (নরসিংহ নামেও পরিচিত) কাছে কিছু জমি চাইলেন তার খানকার জন্য। মহৎ উদ্দেশ্যে রাজা জমি দান করলেন। এরপর বাবা প্রথমে চুপি-চুপি অবহেলিত হিন্দুদের ইসলামের দাওয়াতের কাজে নিবেদিত হলেন। পরে রাজার সেনাপ্রধান, মন্ত্রিও ইসলামের দাওয়াত কবুল করে। সমাজ ব্যবস্থা তখন এক যুগসন্ধিক্ষণ পার করছিল ঘোর ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ধর্মের অপব্যাখ্যা ও জাতপাতের বিভেদ ইসলাম প্রচারের পথকে প্রশস্ত করেছিল।
কিন্তু তাতেও বাবার মন ভরলনা, শুরু করলেন রাজা পরশুরামকে ক্ষমতাচূত্য করার পরিকল্পনা। কিছু নওমুসলিমদেরকে গোহত্যা করতে উৎসাহিত করতে লাগালেন। ইহা রাজা পরশুরামের সহ্য হলনা। কিন্তু আমাদের দয়াল বাবা ইতোমধ্যে তার পরিকল্পনা গুছিয়ে বসেছিলেন, শিষ্য বেশে দক্ষ আফগান সেনাদের তৈরি রেখেছিলেন যুদ্ধের জন্য। এক রাতের অন্ধকার রাজার দূর্গ (মহাস্তানগড়) আক্রমন করলেন। যুদ্ধে রাজা পরশুরাম নিহত হলেন। আমাদের দয়াল বাবা এইবার রাজা। তার মনে নতুন অভিসন্ধি হইল, তিনি রাজা পরশুরামের ছোট বোন শিলা দেবী কে বিয়ের প্রস্তাব ও ইসলাম কবুলের দাওয়াত দিলেন। শিলা দেবী রাজী না হয়াই জোর করে তার সতীত্ব হরণের চেষ্টা করেন। নিজের সম্ভ্রম রক্ষায় শিলা দেবী করতোয়া নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করলেন (শিলা দেবীর ঘাট নামে মহাস্তানে একটি নদীর ঘাট আছে)। দয়াল বাবা তো রাজা হয়ে মরে গেলেন, রেখে গেলেন মাজার আর বাবার নামে মানত ল্যাগেসি।
পূর্বেই বলেছি, দয়াল বাবা দক্ষিণ বাংলার সন্দ্বীপে প্রথমে আখড়া গড়েছিলেন। পুণ্ড্রবর্ধন ধ্বংসের পূর্বে সেখানের হরিরামনগরের স্থানীয় শাক্ত রাজা বলরামকেও তিনি একই ভাবে যুদ্ধে হারিয়েছিলেন ইসলাম প্রচারে বাধা দেবার অজুহাতে। সেখানেও যুদ্ধে রাজা বলরাম মারা যান এবং তাঁর মন্ত্রী ইসলাম গ্রহণ করে প্রাণ বাঁচান। খেয়াল করলে দেখবেন, আজও তৌহিদ জনতা ইসলামের অপমানের অজুহাতে অমুসলিমদের বাড়িঘরে আগুন দিতে, বা তাদের হত্যা করতে পিছপা হয় না। গতকাল (১৫ জুলাই, ২০২২) বাংলাদেশের নড়াইল জেলার লোহাগড় উপজেলার দিঘলিয়া ইউনিয়নের ৮নম্বর ওয়ার্ডের সাহাপাড়ায় হিন্দুদের উপরে বর্বর আক্রমণ হয়েছে)।
একজন সুফী, যিনি কিনা আল্লাহর পথে, শান্তির পথের পথিক, তিনি কেন একের পরে এক যুদ্ধে জড়াবেন! বিষয়টা কি আপনাদের কাছে আশ্চর্য লাগছে না? তিনি কেন মানুষের রক্তে হাত রাঙাবেন, কেন নারীর শ্লীলতাহানি করার চেষ্টা করবেন? সুফী শব্দের উৎস হিসেবে যে তিনটি অর্থ করা হয়, তার একটি হচ্ছে, “সৎ চরিত্রের অধিকারী”। এহেন ঘটনা কতটা ধার্মিক ব্যক্তির পরিচয় বহন করে বা শান্তির পতাকাবাহী হবার যোগ্যতা প্রদান করে সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
শাহ সুলতান বলখীর প্রকৃত পরিচয় এবার উন্মোচনের সময় এসেছে। ইনি ছিলেন আফগানিস্তানের বালখ রাজ্যের সম্রাট শাহ আলী আসগরের পুত্র এবং পিতার মৃত্যুর পর তাকেই সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই জন্যই তার নামের শেষে বালখী রয়েছে। কিন্তু তিনি তার সাম্রাজ্য ছেড়ে দরবেশ হয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে তার গুরুর আদেশে ইসলাম প্রচারের জন্য বাংলায় আসেন। কথিত আছে শাহ সুলতান প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের নিরীহ শিষ্যের বেশে এবং নিজে ফকিরবেশে একটি মাছ আকৃতির নৌকাতে করে বাংলায় এসেছিলেন। তা ছাড়া একজন সম্রাট হিসেবে তিনিও আবশ্যই ছিলেন রণনীতিতে সুনিপুন একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং তিনি যে মিশন নিয়ে বাংলায় এসেছিলেন, তা পূর্ব পরিকল্পিত ছিল বললে মিথ্যা বলা হয় না।
যে মানুষ তার আশ্রিত রাজার প্রতি এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে, তাকে আর যাই বলা যাক মহামানব বলা চলে নয়া। শান্তির পতাকার আড়ালে লুকানো শাণিত অস্ত্র। ছদ্মবেশে এসে একের পর এক হিন্দু রাজ্য এ’ভাবে ধংস করতে পারে, তার নামে, তার মাজারের নামে মানত কিভাবে একজন হিন্দু করতে পারে? ইসলামে নিজেই এ’ধরণের বিশ্বাসঘাতকদেরকে তো মুনাফেক নাম দিয়েছে। আপনার পূর্বপুরুষদের যে বাস্তুছাড়া করলো, যাদের জন্য আপনি এখন আপন ভূমে পরবাসী, সেই হিন্দু হয়ে আপনি কি সামান্য কিছু পার্থিব লাভের মোহে সেই সুফীর কাছে মাথা নত করবেন? আপনি কি তা করতে পারেন? আমরা অন্য ধর্মের প্রতি এতটাই উদার যে ভগবানরে না, দয়াল বাবার কাছে দুই হাত তুলে চাই ! ধিক, এমন যারা ভাবে, ধিক, যারা করে। তারা কেমন করে এইসব বিশ্বাসঘাতকদের কাছে, হিন্দুদের শত্রুদের কাছে মানত, মাথা নত করতে পারে!
এইখানেই যদি শেষ করতে পারতাম, নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করতাম। কিন্তু না, আমি দেখেছি অনেক গ্রামে-শহরে বুড়া-বিবি, ওলাবিবি, বনবিবি (বা কোন আঞ্চলিক নাম) নামের একটা জায়গা থাকে যাতে হিন্দু-মুসলিম সবাই শিন্নি দেয়, ধূপ-ধুনো দেয়। সাম্প্রদায়িক ভান কারী বুদ্ধিজীবিদের মুখে বুলি ওঠে, আহা অসাম্প্রদায়িকতার কি দৃষ্টান্ত। আমি বলি নাহ, এই সব বিবির পূজা চলবে না। ইহা মুসলিম ধর্মের প্রচারের হলফনামা। আজ প্রতিটি পীর সাহেবদের দরগাহ, প্রতিটি খানকাহ গড়ে উঠেছে একেকটি হিন্দু রাজ্যের পতনের ধ্বংসাবশেষের ওপরে। এরাই সেই মিশনারী যারা বাংলায় এসেছিল বাংলার হিন্দুদের মুসলমান ধর্মে দীক্ষা দিতে। তাহলে একজন হিন্দু কিভাবে এই কবরের উপর মানত করে, ধুপ-ধুন দেয়? এইটা একটা অপসংস্কার, যা সময়ের পরিক্রমায় হিন্দু সমাজে ঢুকে পরেছে। ইহাকে পরিত্যাগ করতে হবে, নইলে এরকম আরও শতশত অপসংস্কার ও কুসংস্কার মাথা তুলে দাঁড়াবে ভবিষ্যতে।