অপরাজিতা দুর্গা | Aparajita Durga | Shri Kushal Baran Chakraborty
ঈশানকোণের অধিষ্ঠাতা হলেন ভগবান শিব। তাই শিবের শক্তিরূপী উত্তর-পূর্ব বা ঈশানকোণের অধিষ্ঠাত্রী হলেন ঈশানী। দেবী ঈশানীকে অপরাজিতা দুর্গাও বলা হয়। অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে উদ্দেশ্য করে উত্তর পূর্ব দিককে অপরাজিতা দিক বলা হয়। ঋগ্বেদের আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রেও অপরাজিতা দিকের এমন ব্যবহার দেখা যায়।
অথাপরাজিতায়াং দিশ্যবস্থায় স্বস্ত্যাত্রেয়ং
(আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র:৩.১১.২)
"এরপর অপরাজিতা দিকে অথবা উত্তর-পূর্বদিকে দাঁড়িয়ে স্বস্ত্যাত্রেয় সূক্ত (ঋগ্বেদ সংহিতা:৫.৫১.১১) এবং ‘যত ইন্দ্ৰ-’ (ঋগ্বেদ সংহিতা:৮.৬১.১৩) এই অবশিষ্ট সূক্তাংশ জপ করতে হবে।"
আহিতাগ্নিশ্ চেদ্ উপতপেত্ প্রাচ্যাম্ উদীচ্যাম্ অপরাজিতায়াং বা দিশ্যুদবস্যেত্ ।।১।।
(আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র:৪.১.১)
"আহিতাগ্নি ব্যক্তি যদি ব্যাধিগ্রস্ত হন, তিনি গৃহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে অগ্নিসমেত অপরাজিতা দিকে অথবা উত্তর-পূর্ব দিকে যাবেন।"
উত্তর-পূর্ব বা ঈশানকোণকে যে অপরাজিতা দুর্গার নামে অপরাজিতা দিক বলা হয় এ গৃহসূত্রসহ বৈদিক বিভিন্ন স্থানের ব্যতিরেকে স্মৃতিশাস্ত্রেও দেখতে পাই। বিশেষ করে মনুসংহিতায়:
অপরাজিতাং বাস্থায় ব্রজেদ দিশমজিহ্মগঃ।
আ নিপাতাচ্ছরীরস্য যুক্তো বাৰ্য্যনিলাশনঃ।।
(মনুসংহিতা:৬.৩১)
"এইরকম করতে করতে বানপ্রস্থাশ্রমী যদি অপ্রতিবিধেয় রোগে আক্রান্ত হয়, অর্থাৎ যে রোগে নিরাময় নেই; তবে যে পর্যন্ত না দেহপাত হয়, সেই পর্যন্ত কেবল জল ও বায়ু ভক্ষণ করে যোগনিষ্ঠ হয়ে অপরাজিতা দিক্ অর্থাৎ উত্তর-পূর্ব দিক্ লক্ষ্য ক'রে সরলগতি অবলম্বনপূর্বক একাগ্রভাবে চলতে থাকবে।"
দেবীপুরাণে অপরাজিতা শব্দের নাম নিরক্তিতে বলা হয়েছে, দৈত্যদের জয় করেছেন বলে, তাঁর নাম 'বিজয়া' এবং সদা দৈত্যদের বিনাশ করে তাদের উপরে বিজয় লাভ করেন বলে দেবীকে বিজয়া নামে সাথে 'অপরাজিতা' নামে অবিহিত করা হয়।
জয়ন্তী জয়নাখ্যাতা অর্জিতা ন জিতা ক্বচিৎ ।
বিজিত্য পদ্মনামানং দৈত্যরাজং মহাবলম্ ।।
বিজয়া তেন সা দেবী লোকে চৈরাপরাজিতা ।।
(দেবীপুরাণ:৩৭.১৩)
"দেবী সর্বত্র জয় লাভ করেন বলে, তাঁর নাম 'জয়ন্তী' । তাঁকে কেউ জয় করতে পারে না, তাই তাঁর নাম 'অজিতা'। মহাবল পদ্মনামক দৈত্যরাজকে জয় করেছেন বলে, তাঁর নাম 'বিজয়া' এবং লোকে তখন থেকে আজও দেবীকে 'অপরাজিতা' নামে অবিহিত করে।"
দুর্গাপূজার বিজয়াদশমীর দিন অপরাজিতা দেবীর পূজা করা হয়। 'অপরাজিতা’ দুর্গা চৌষট্টী যোগিনীর অন্যতমারূপে বর্ণিতা। দেবীর ধ্যানমন্ত্রে বলা হয়েছে :
ওঁ চতুর্ভুজাং পীতবস্ত্রাং সর্বাভরণভূষিতাং।
উপরিদ্বয়ো হস্তয়োঃ খড়্গাচর্মধরাং অধস্তনহস্তয়োর্বরাভয়করাং।
ঈষৎপ্রহসিতাননাং বাগ্মিনীম্।।
দুর্গাপূজাতেও দশমীর দিন দশমীবিহিত পূজার শেষে ঘট বিসর্জনের পর ঈশানকোণে অষ্টদল পদ্ম অঙ্কন করে , সেই অষ্টদল পদ্মের উপরে অপরাজিতা ফুল গাছের লতা রেখে দেবী অপরাজিতা দুর্গাকে পূজা করার রীতি বঙ্গের বহু অঞ্চলেই প্রচলিত। দেবীর সাথে নামের সাদৃশ্যের জন্যই অপরাজিতা লতাকে দেবীর স্বরূপে পূজা করা হয়।পূজায় দেবী অপরাজিতার ধ্যানমন্ত্র হল:
নীলোৎপলদলশ্যামাং ভুজগাভরণোজ্জ্বলাং
বালেন্দুমৌলিনীং দেবীং নয়নত্রিতয়ান্বিতাম্ ।
শঙ্খচক্রধরাং দেবীং বরদাং ভয়নাশিনীম্।
পীনোত্তুঙ্গস্তনাং শ্যামাং বরপদ্মস্থমালিনীম্ ॥
"নীলপদ্মের পাপড়ির তুল্য শ্যামবর্ণা, সর্পের অলংকারে উজ্জ্বলা, মস্তকে কলাচন্দ্রশোভিতা, ত্রিনয়নসমন্বিতা, শঙ্খচক্রধারিণী বরদা ও অভয়দাত্রী, পীনোন্নতন্তনী, শ্যামা শ্রেষ্ঠ পদ্মমাল্য বিভূষিতা।"
এ দুটি ধ্যানমন্ত্র ছাড়াও দেবী অপরাজিতার আরও কয়েকটি ধ্যানমন্ত্র পাওয়া যায়। সে ধ্যানমন্ত্রগুলোতে দেবী কোথাও পীতবস্ত্র, কোথাও শুক্লবস্ত্র-পরিহিতা দেখা যায়। অর্থাৎ ধ্যানমন্ত্রের বর্ণনা অনুসারে দেবীর অনেক রূপভেদ পাওয়া যায়। বৌদ্ধতন্ত্রেরও বিবিধ স্থানে অপরাজিতা দেবীর ধ্যানমন্ত্র রয়েছে:
অপরাজিতা পীতা দ্বিভুজৈকমুখী
নানারত্নোপশোভিতা গণপতিসমাক্রান্তা
চপেটদানাভিনয়দক্ষিণকরা গৃহীত পাশতর্জনিকহৃদয়স্থিতবামভুজা
অতিভয়ঙ্করকরালরৌদ্রমুখী অশেষমারনির্দলনী ব্রহ্মাদিদুষ্টরৌদ্র দেবতাপরিকরোচ্ছ্রিতচ্ছত্রা চেতি।
বৌদ্ধতন্ত্রে অষ্টভুজা কুরুকুল্লাসাধনে এবং তাঁর ধ্যানে এই অপরাজিতাদেবীর উল্লেখ আছে। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী-সম্পাদিত এবং সংস্কৃত সাহিত্য পরিষদের প্রকাশিত ‘বৌদ্ধ গান ও দোঁহা’ গ্রন্থেও দেবী অপরাজিতার নামের উল্লেখ রয়েছে। ভারতবর্ষের পূর্বাংশের সর্ববৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নালন্দাবিহার। এ নালন্দার ধ্বংসস্তূপ থেকেও দেবী অপরাজিতা দুর্গার একটি ভগ্ন মূর্তি পাওয়া গেছে। দেবী অপরাজিতার একটি প্রাচীন মূর্তি কলিকাতা মিউজিয়ামেও সংরক্ষিত রয়েছে।মৎস্যপুরাণে অপরাজিতা দুর্গা বত্রিশ মাতৃকাগণের অন্যতমারূপে আখ্যাতা।
সঙ্কৰ্ষণী তথার্শ্বত্থা বীজভাবাপরাজিতা ॥
কল্যাণী মধুদংষ্ট্ৰী চ কমলোৎপলহস্তিক।
ইতি দেব্যষ্টকং রাজন্ মায়ানুচরমুচ্যতে।।
(মৎস্যপুরাণ: ১৭৯.৬৯-৭০)
"হে রাজা, সঙ্কর্ষণী, অর্শ্বথা, বীজভাবা, অপরাজিতা, কল্যাণী, মধুদংষ্ট্ৰী ও কমলোৎপলহস্তি এই অষ্টমাতৃকা মহামায়ার অনুচরী বলে অবিহিতা।"
সর্ববিঘ্নবিনাশিনী এবং সর্বকামপ্রদায়িনী দেবী অপরাজিতা দুর্গা সম্পর্কে স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ তাঁর 'মহিষাসুরমর্দ্দিনী-দুর্গা' নামক দুর্গাতত্ত্বের উপরে সুবিখ্যাত গ্রন্থে বলেছেন:
দেবী অপরাজিতা সর্ববিঘ্নবিনাশিনী ও সর্বকামপ্রদায়িনী। দুর্গাপূজার ষষ্ঠী-আদি কল্প থেকে নবমী পর্যন্ত পূজা ক’রে দশমীতিথিতে দেবীকে জলে স্থাপন বা বিসর্জনের পর কুলাচার অর্থাৎ কুলপ্রথা অনুসারে অপরাজিতার পূজা করতে হয়। দুর্গাপূজায় সকল রকম দোষ ও ত্রুটী দূর করার জন্য ও বিজয়-কামনায় এই অপরাজিতাপূজা করতে হয়। অপরাজিতাপূজার প্রকরণ ও বিধি ভারতের বিশেষত বঙ্গের বিভিন্ন স্থানে কুলাচার অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন রকম দাঁড়িয়েছে। কোথাও বা পূজানুষ্ঠানের পরিবর্তে আচার-অনুষ্ঠানমাত্রই স্থান পেয়েছে। ক্রিয়াকাণ্ডবারিধি, আচারপদ্ধতি, পুরোহিতদর্পণ ও অন্যান্য পূজার গ্রন্থে দেখা যায় যে, বিধিমত পূজার পর "...অপরাজিতা রুদ্রলতা ‘করোতু বিজয়ং মম’-মন্ত্রে প্রণাম ক'রে বিজয় প্রার্থনা করা হয়”।
এরপর দেবীকে মন্ত্রসহ প্রদক্ষিণ ক’রে ধারণমন্ত্রে দক্ষিণ বাহুতে ঐ অপরাজিতালতা বাঁধবারও নিয়ম আছে। পূর্ববঙ্গে বিশেষতঃ শ্রীহট্টে (আসামে) এই সম্বন্ধে একটি কুলপ্রথারও প্রচলন আছে। দশমীতে একটি পাত্রে অপরাজিতালতা রেখে তাতে দেবী দুর্গার আবাহন ও অর্চনা করা হয়। পূজার শেষে ঐ অপরাজিতালতা টুকরো টুক্রো ক’রে কেটে শ্বেতসর্ষপ ও হরিদ্রার সঙ্গে হরিদ্রারঞ্জিত কাপড়ে ছোট ছোট পুঁটুলিতে বাঁধা হয় এবং হরিদ্রাবর্ণ সূতা দ্বারা প্রত্যেক লোকের দক্ষিণ বাহুতে বেঁধে দেওয়া হয়। একে এক রকমের রাখীবন্ধন বলে। কালিকাপুরাণোক্ত দুর্গাপূজায় বিজয়াদশমীকৃত্যে দেখা যায় দেবীর বিজয়ার পর সকলের ডানহাতে শ্বেত অপরাজিতালতা বাঁধবার প্রথা আছে। এরপর “ওঁ নিমজ্জাম্ভসি সম্পূজ্য পত্রিকাবর্জিতা জলে; পুত্রায়ুর্ধনবৃদ্ধ্যর্থং স্থাপিতাসি জলে ময়া"-মন্ত্রে দেবীকে জলে স্থাপন করতে হয়। তারপর জলক্রীড়া, মঙ্গলাচরণ, কলসের শান্তিবারি দান ও ডানহাতে শ্বেত অপরাজিতালতা বন্ধন করারও নিয়ম দেখা যায়। তা ছাড়া বৃহন্নন্দিকেশ্বর, কালিকাপুরাণ ও মৈথিলী শ্রীদুর্গাভক্তিতরঙ্গিণীর মতে নবপত্রিকার অনুষ্ঠানেও বিঘ্ন দূর করার জন্যে অপরাজিতালতার ব্যবহার দেখা যায়।
(স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ ২০০৮: ৩১৩)
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের দ্বিতীয় অধিকরণের চতুর্থ অধ্যায়ে দুর্গ নগরের মধ্যবর্তী স্থানে অপরাজিতা দুর্গাদেবীর মন্দির নির্মাণ করতে বলা হয়েছে।
(পুরমধ্যে বহিশ্চ দেবালয়-নির্মাণবিধিঃ)
অপরাজিতাঽপ্রতিহত-জয়ন্ত বৈজয়ন্ত-কোষ্ঠকান্
শিব-বৈশ্রবণাশ্বিশ্রী-মদিরা গৃহাণি চ পুরমধ্যে কারয়েৎ।
কোষ্ঠকালয়েষু যথোদ্দেশং বাস্তু-দেবতাঃ স্থাপয়েৎ। ব্রাহ্মৈন্দ্রযাম্য-সৈনাপত্যানি দ্বারাণি।
বহিঃ পরিখায়া ধনুঃশতাপকৃষ্টাশ্চৈত্য-পুণ্যস্থান-বন
সেতুবন্ধাঃ কার্যাঃ, যথাদিশং চ দিগ্দেবতাঃ।
(কৌটিলীয়ম্ অর্থশাস্ত্রম্:২.৪.৫)
"দুর্গ নগরের মধ্যবর্তী স্থানে অপরাজিতা দুর্গা, অপ্রতিহত (বিষ্ণু), জয়ন্ত (ইন্দ্রপুত্র বা সুহ্মণ্য) ও বৈজয়ন্তের (ইন্দ্র) আলয় বা মন্দির এবং শিব, বৈশ্ৰবণ (কুবের), অশ্বিনীকুমারদ্বয়, শ্রী বা লক্ষ্মী ও মদিরা দেবীর (দুর্গার নামবিশেষ) মন্দির নির্মাণের ব্যবস্থা করতে হবে। পূর্বোক্ত কোষ্ঠ ও মন্দিরসমূহে সেই সকল স্থানের প্রচলিত রীতি অনুসারে, সে সকল অঞ্চলের বাস্তুদেবতাদেরও স্থাপন করতে হবে। নগরের চারদিকে বিভিন্ন দেবতার নামে দ্বার নির্মাণ করাতে হবে। যেমন, উত্তর দিকে ব্রহ্মদেবতাত্মক 'ব্রাহ্ম-দ্বার', পূর্বদিকে ইন্দ্রসম্পর্কীয় 'ইন্দ্রদ্বার', দক্ষিণ দিকে যম-সম্পর্কীয় 'যাম্য-দ্বার' এবং পশ্চিমদিকে দেবসেনাপতি কার্তিকেয় সম্পৰ্কীয় 'সৈনাপত্য-দ্বার'। নগরের বাইরে পরিখা থেকে ধনুঃশত বা দণ্ডশত (চারশ হাত) ব্যবধানে চৈত্য, পুণ্যস্থান, বন ও সেতুবন্ধ স্থাপন করাতে হবে, এবং নিজ নিজ দিক্ অনুসারে দিগ্দেবতাদের আলয় স্থাপন করাতে হবে।"
অপরাজিতা দেবীর অসুরবিনাশিনী রূপ। শ্রীচণ্ডীর উত্তরচরিত্রের পঞ্চম অধ্যায় এবং অষ্টম অধ্যায়ের দুটি স্থানে অপরাজিতা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। শুম্ভনিশুম্ভকে বিনাশের উদ্দেশ্যেই শব্দটি ব্যবহৃত। উত্তরচরিত্রের শুরুতে পঞ্চম অধ্যায়ে দেবীকে অপরাজিতা বলে সম্বোধন করেছেন দেবতাগণ। তাঁরা শুম্ভনিশুম্ভ নামক মহাসুরদ্বয় কর্তৃক স্ব-স্ব অধিকার হতে বিচ্যুত ও স্বর্গ হতে বিতাড়িত হয়ে বিপদ থেকে উদ্ধারে আদ্যাশক্তি মহামায়ার স্মরণ করে। তখন দেবী অপরাজিতা দুর্গারূপে দেবতাদের সম্মুখে আবির্ভূত হন। অপরাজিতা তাঁকেই বলা হয়, যাঁকে কখনো পরাজিত করা যায় না।
হতাধিকারাস্ত্রিদশাস্তাভ্যাং সর্বে নিরাকৃতাঃ ।
মহাসুরাভ্যাং তাং দেবীং সংস্মরন্ত্যপরাজিতাম্ ॥
তয়াস্মাকং বরো দত্তো যথাপসু স্মৃতাখিলা ।
ভবতাং নাশয়িষ্যামি তৎক্ষণাৎ পরমাপদঃ ॥
(শ্রীচণ্ডী:৫.৫-৬)
সকল দেবতারা সম্মিলিতভাবে মহাদেবীর সন্তুষ্টির জন্য, তাঁর উদ্দেশ্যে স্তব করে। দেবতাদের স্তবে প্রসন্ন হয়ে অপরাজিতারূপিণী দুর্গা শুম্ভনিশুম্ভ নামক অসুরভ্রাতৃদ্বয়কে বিনামশ করে। দেবতাদের কৃত এ অপরাজিতাস্তবকে তান্ত্রিক দেবীসূক্ত নামেও অবিহিত করা হয়। দেবতারা তাদের স্তবে দেবীকে সৃষ্টিশক্তিরূপিণী প্রকৃতি, স্থিতিশক্তিরূপিণী ভদ্রা এবং সংহারশক্তিস্বরূপা রৌদ্রা নামে অবিহিত করে সেই মহাদেবীকে প্রণাম করেছেন। দেবী নিত্যা, গৌরী, জগৎপ্রসবিনী জগদ্ধাত্রী, দুরধিগম্যা দুর্গা, দুস্তর সংসার সমুদ্র থেকে পরিত্রাণকারী, শক্তিরূপিণী, সর্ব কারণের কারণ, আদ্যাশক্তি নামে খ্যাতা, কৃষ্ণবর্ণা ও ধূম্রবর্ণাসহ অনন্তবর্ণা। দেবতাদের সম্মুখে আবির্ভূতা দেবী অপরাজিতাই যে দেবী দুর্গা এ বিষয়টি আমরা অপরাজিতাস্তবে সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাই। তিনিই বিদ্যারূপে অতিসৌম্যা এবং অবিদ্যারূপে অতি রৌদ্রা। তিনিই জগতের আশ্রয়রূপিণীকে এবং তিনিই ক্রিয়ারূপা। সেই দেবী সকল প্রাণীতে বিষ্ণুমায়া নামে শাস্ত্রে অভিহিতা।
দেবা ঊচুঃ । ৮ (ওঁ ঐ)
নমো দেব্যৈ মহাদেব্যৈ শিবায়ৈ সততং নমঃ।
নমঃ প্ৰকৃত্যৈ ভদ্রায়ৈ নিয়তাঃ প্রণতাঃ স্ম তাম্ ॥ ৯
রৌদ্রায়ৈ নমো নিত্যায়ৈ গৌৰ্যৈ ধাত্র্যৈ নমো নমঃ । জ্যোৎস্নায়ৈ চেন্দুরূপিণ্যৈ সুখায়ৈ সততং নমঃ ॥ ১০ কল্যাণ্যৈ প্ৰণতা বৃদ্ধ্যৈ সিদ্ধ্যৈ কুৰ্মো নমো নমঃ ।
নৈঋত্যৈ ভূভৃতাং লক্ষ্ম্যৈ শৰ্বাণ্যৈ তে নমো নমঃ ॥১১
দুর্গায়ৈ দুর্গপারায়ৈ সারায়ৈ সর্বকারিণ্যৈ ।
খ্যাত্যৈ তথৈব কৃষ্ণায়ৈ ধূম্ৰায়ৈ সততং নমঃ ॥ ১২
অতিসৌম্যাতিরৌদ্রায়ৈ নতাস্তস্যৈ নমো নমঃ ।
নমো জগৎপ্রতিষ্ঠায়ৈ দেব্যৈ কৃত্যৈ নমো নমঃ ॥ ১৩
যা দেবী সর্বভূতেষু বিষ্ণুমায়েতি শব্দিতা।
নমস্তস্যৈ (১৪) নমস্তস্যৈ (১৫) নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥ ১৬
(শ্রীচণ্ডী:৫.৮-১৬)
"মহামায়া অপরাজিতাকে দেবগণ বললেন—দেবীকে প্রণাম এবং মহাদেবীকে প্রণাম। সতত মঙ্গলদায়িনীকে প্রণাম। সৃষ্টিশক্তিরূপিণী প্রকৃতিকে প্রণাম। স্থিতিশক্তিরূপিণী ভদ্রাকে প্রণাম। নিত্য আমরা সমাহিত চিত্তে তাঁকে প্রণাম করি।
সংহারশক্তিস্বরূপা রৌদ্রাকে প্রণাম। অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ এ ত্রিকালাতীত সত্তারূপিণীকে নিত্যাকে প্রণাম। গৌরী এবং জগদ্ধাত্রীকে প্রণাম। জ্যোৎস্নারূপা, চন্দ্ররূপা ও সুখস্বরূপাকে সতত প্রণাম। কল্যাণী, সমৃদ্ধিরূপা ও সিদ্ধিরূপা দেবীকে বারবার প্রণাম করি। অলক্ষ্মীরূপা, ভূপতিগণের লক্ষ্মীরূপা শর্বাণী দেবীকে বারবার প্রণাম করি। দুরধিগম্যা দুর্গা, দুস্তর সংসার সমুদ্র থেকে পরিত্রাণকারী, শক্তিরূপিণী, সর্ব কারণের কারণ, আদ্যাশক্তি নামে খ্যাতা, কৃষ্ণবর্ণা ও ধূম্রবর্ণা দুর্গা দেবীকে বারবার প্রণাম করি।
বিদ্যারূপে অতিসৌম্যা এবং অবিদ্যারূপে অতি রৌদ্রাকে প্রণাম করি। তাঁকে বারবার প্রণাম। জগতের আশ্রয়রূপিণীকে এবং ক্রিয়ারূপা দেবীকে বারবার প্রণাম। যে দেবী সকল প্রাণীতে বিষ্ণুমায়া নামে বেদাদি শাস্ত্রে অভিহিতা; তাঁকে নমস্কার। তাঁকে নমস্কার। তাঁকে বারংবার নমস্কার।"
মধ্যমচরিত্রের অষ্টম অধ্যায়ে অপরাজিতা দেবী দুর্গা ভগবান শিবকে শুম্ভনিশুম্ভের কাছে তাদের কল্যাণের জন্য বার্তাবহরূপে প্রেরণ করেন।
সা চাহ ধূম্রজটিলমীশানমপরাজিতা ।
দূতত্বং গচ্ছ ভগবন্ পাৰ্শ্বং শুম্ভনিশুম্ভয়োঃ ॥
(শ্রীচণ্ডী:৮.২৪)
"সেই অপরাজিতা দেবী ধূম্রবর্ণজটাধারী মহাদেবকে বললেন— ভগবন, আপনি শুম্ভ ও নিশুম্ভের নিকটে বার্তাবহরূপে গমন করুন।"
দেবীপুরাণের নারদ মুনির স্তবে অপরাজিতা দেবীর উল্লেখ রয়েছে :
সর্বজ্ঞা সর্বতোভদ্রা সর্বতোঽক্ষিশিরোমুখা ।
সর্বভূতাদিমধ্যান্তা সর্বলোকেশ্বরেশ্বরী ।।
মানবী যাদবী দেবী যোগনিদ্রাথ বৈষ্ণবী ।
অরূপা বহুরূপা চ সুরূপা কামরূপিণী ।।
শৈলরাজসুতা সাধ্বী স্কন্দমাতাচ্যুতস্বসা ।
জয়া চ বিজয়া দেবী অজিতা চাপরাজিতা ।।
শ্রুতিঃ স্মৃতির্ধৃতিঃ ক্ষান্তিঃ শক্তিঃ শান্তিরথোন্নতিঃ ।
প্রকৃতির্ব্বিকৃতিঃ কীর্ত্তিঃ স্থিতিঃ সন্ততিরেব চ ।।
( দেবীপুরাণ: ১৬.২৬-২৯ )
" হে দেবী, কোন বিষয়ই আপনার অজ্ঞাত নহে- তাই আপনাকে ‘সর্বজ্ঞা’ বলা হয়। সর্বস্থানে আপনার নয়ন, মস্তক ও মুখমণ্ডল বিদ্যমান থাকায় আপনার এক নাম ‘সর্বতোঽক্ষিশিরোমুখা’। আপনার এক নাম ‘সর্বতোভদ্রা’। আপনি সর্ব জীবের আদি- মধ্য- অন্ত। আপনি সকল লোকপালদিগের প্রভু , সেই জন্য আপনাকে ‘সর্বভূতাদিমধ্যান্তা’ ও ‘সর্বলোকেশ্বরী’ বলে । আপনি মানবী, যাদবী, দেবী, যোগনিদ্রা, বৈষ্ণবীশক্তি, অরূপা, বহুরূপা, সুরূপা, কামপূর্ণকারিণী বলে খ্যাতা হন। আপনি হিমালয় কন্যা- তাই আপনার এক নাম ‘শৈলরাজসুতা’। আপনি ‘সাধ্বী’ নাম ধারণ করেন। কার্তিকের মাতা বলে আপনার এক নাম ‘স্কন্দমাতা’। আপনি অচ্যুতস্বসা, জয়া, বিজয়া, অজিতা, অপরাজিতা , শ্রুতি, স্মৃতি, ধৃতি, কান্তি, শক্তি, শান্তি, উন্নতি, প্রকৃতি, বিকৃতি, কীর্তি, স্থিতি ও সন্ততি এ সকল নামেই অভিহিতা হন।"
দেবীপুরাণে বৈশাখ মাসের অষ্টমী তিথিতে অপরাজিতা ভবানী দেবীকে যথাসাধ্য বিবিধ প্রকারের দ্রব্যাদি দিয়ে অভিষেক করে পূজা করতে বলা হয়েছে। দেবীর পূজান্তে ব্রাহ্মণ ও কুমারী কন্যাকে ভোজন করিয়ে তাদের যথাশক্তি দক্ষিণা দিয়ে স্বস্তিবাচন করতে বলা হয়েছে। বৈশাখ মাসে দেবী অপরাজিতা ভবানীর পূজার ফলশ্রুতিতে বলা হয়েছে, পূজক দেহান্তে সূর্যলোকে গমন করে, মৃত্যু পরবর্তীতে সূর্যতুল্য গ্রহরূপে বিরাজ করবে।
সহকারফলং স্নানং বৈশাখে হ্যষ্টমীষু চ।
আত্মনো দেবতাং স্নাপ্য মাংসীবালকবারিভিঃ।।
লেপনং মধু কর্পূর-ধূপং পঞ্চসুগন্ধিকম্ ।
দেব্যাঃ পূজাঞ্চ কুর্বীত কেতকীমদনেন চ।।
ক্ষীরং শর্করনৈবেদ্যং কন্যাবিপ্রেষু ভোজনম্ ।
আত্মনঃ পাবনং তচ্চ দক্ষিণাং শক্তিতো দদেৎ ৷৷
অপরাজিতাভবানীং স্বস্তিনামেন বাচয়েৎ।
প্রীয়তাং সৰ্বকালং মে ঈপ্সিতন্তু প্রযচ্ছতু ৷৷ সৰ্বতীর্থাভিষেকন্তু অনেনাপ্নোতি ভার্গব ।
সূৰ্য্যলোকং ব্রজেদস্তে তৎতুল্যো ভবতে গ্রহ ৷।
(দেবীপুরাণ: ৩৩.৯৩-৯৭)
"বৈশাখ মাসের অষ্টমী তিথিতে সহকার ফল মিশ্র জল দ্বারা এবং জটামাংসী (এক ধরনের গিরাযুক্ত সুগন্ধি ঔষধি উদ্ভিদ) ও কর্পূর মিশ্র জল দ্বারা স্নান করাবে। মধু ও কর্পূর বিলেপন, পঞ্চ-সুগন্ধি ধুপ, কেতকীপুষ্প ও মদনপুষ্প দ্বারা পূজা, ক্ষীর ও শর্করা নৈবেদ্য প্রভৃতি দ্বারা দেবীর পূজা করবে। পূজান্তে ব্রাহ্মণ ও কুমারীকে ভোজন করিয়ে তাদের যথাশক্তি দক্ষিণা দিয়ে স্বস্তিবাচন করবে।
অপরাজিতা ভবানী দেবী সর্বদা আমার প্রতি প্রসন্না হইয়া ঈপ্সিত ফল প্রদান করুন -এই বলে প্রার্থনা করবে।
এমন করে দেবীর পূজা করলে সর্বতীর্থাভিষেকের ফললাভ হয় এবং দেহান্তে সূর্যলোকে গমন করে, মৃত্যু পরবর্তীতে সূর্যতুল্য গ্রহরূপে বিরাজ করতে থাকে।"
বেদের ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে, ব্রহ্মার পুরীর নাম অপরাজিতা। সেখানে ব্রহ্মার দ্বারা বিশেষরূপে সৃষ্ট হিরণ্ময় মণ্ডপ আছে। ব্রহ্মার নিবাসের নাম অপরাজিতা। অর্থাৎ শাক্ততত্ত্ব অনুসারে বলা যায়, ব্রহ্মার শক্তি, ব্রহ্মাণীই হলেন অপরাজিতা।
অথ যদনাশকায়নমিত্যাচক্ষতে ব্রহ্মচর্যমেব তদেষ হ্যাত্মা ন নশ্যতি যং ব্রহ্মচর্যেণানুবিন্দতেঽথ যদরণ্যায়নমিত্যাচক্ষতে ব্রহ্মচর্যমেব তৎ তদরশ্চ হ বৈ ণ্যশ্চার্ণবৌ ব্রহ্মলোকে তৃতীয়স্যামিতো দিবি তদৈরম্মদীয়ং সরস্তদশ্বত্থঃ সোমসবনস্তদপরাজিতা পূর্বহ্মণঃ প্রভুবিমিতং হিরণ্ময়ম্ ॥
(ছান্দোগ্য উপনিষদ: ৮.৫.৩)
"আবার লোকে যাকে অনাশকায়ন বলে, তাও ব্রহ্মচর্য; কারণ ব্রহ্মচর্যের দ্বারা যে আত্মাকে লাভ করা হয় সেই আত্মার নাশ হয় না। আবার যাকে অরণ্যায়ন বলে, তাও ব্রহ্মচর্য। সেই ব্রহ্মলোকে— অর্থাৎ এই পৃথিবী লোক থেকে গণনা করে তৃতীয় দ্যুলোক নামক লোকে অর ও ণ্য নামক সমুদ্রদ্বয় আছে। সেখানে ঐরম্মদীয় সরোবর আছে; সেখানে অমৃতস্রাবী অশ্বত্থ আছে; সেখানে ব্রহ্মার অপরাজিতানাম্নী পুরী আছে; সেখানে ব্রহ্মার দ্বারা বিশেষরূপে সৃষ্ট হিরণ্ময় মণ্ডপ আছে।"
তথ্যনির্দেশ:
১.স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, মহিষাসুরমর্দ্দিনী-দুর্গা, শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ, কলকাতা: ২০০৮
Aparajita Durga