Translate

বিদ্যার্থীর সুখ হয় না, সুখার্থীর বিদ্যা লাভ হয় না | Gurukula | Shri Kushal Baran Chakraborty

Gurukula
Gurukula

জগতের মানুষকে বিভিন্ন প্রকারে ভাগ করা যায়। এই বিভিন্ন প্রকারের ভাগের মধ্যে বিদ্যা অর্জনের ক্ষেত্রে মানুষকে দুইপ্রকারে ভাগ করা যায়। একপ্রকার হলো সুখার্থী এবং অন্যপ্রকার হলো বিদ্যার্থী। একজন সর্বদা সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের পিছনে দৌড়ায় এবং অন্যজন আমৃত্যু বিদ্যার পিছনে দৌড়ায়।মানুষ জন্ম থেকে আমৃত্যু বিদ্যার্থী ; একদিনের শিশু থেকে শতবছরের বৃদ্ধ প্রত্যেকেই একজন বিদ্যার্থী।


বিদ্যার পিছনে যে দৌড়ে চলে সে ইন্দ্রিয়ের সুখকে গ্রাহ্য করে না। এই ইন্দ্রিয়ের সুখ হলো এমন যে, যত উপভোগ করে ততই বেড়ে চলে। আগুনের মধ্যে ঘি দিলে আগুন যেমন দিনে দিনেই বেড়েই চলে, তেমনি ভোগের আগুনে দাউদাউ করে ভোগের আকাঙ্ক্ষাই বেড়ে চলে। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে নিরাসক্তির জল ভোগে ঢেলে দিতে হবে। মানুষের জীবনের সময়, সুযোগ, সাধ্য এ সকল কিছুই পরিপূর্ণভাবে থাকে না। কিছুটা ঘাটতি থাকে। এ ঘাটতি কখনই পূর্ণ হয় না। যেমন ছয়ফিটের মানুষের সম্পূর্ণ দেহ ঢাকতে যদি পাঁচফিটের একটি কাপড় দেয়া হয়, তবে সেই পাঁচফিটের কাপড় দিয়ে কখনই দেহ সম্পূর্ণভাবে ঢাকা যায় না।


এবং ঢাকা আদৌ সম্ভব নয়। পা ঢাকতে গেলে মাথা বের হয়ে আসে এবং মাথা ঢাকতে গেলে পা বেরিয়ে আসে। এভাবেই জীবন এগিয়ে যায় জীবনের পথরেখায়। তাই বিদ্যার্থীদের কখনই সুখ এবং ভোগে জীবন অতিবাহিত করা উচিত নয়। বিষয়টি মহাভারতের উদ্যোগ পর্বেও সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, যে বিদ্যার্থী সুখার্থী হয়ে সর্বদা সুখের পিছনে দৌড়ায়, সে কখনও বিদ্যা লাভ করতে পারে না। একজন বিদ্যার্থীর অহেতুকী সুখের আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করতে হয়। (বিদ্যার্থীর সুখ হয় না, সুখার্থীর বিদ্যা লাভ হয় না)


আলস্যং মদমোহৌ চ চাপলং গোষ্ঠিরেব চ ।
স্তব্ধতা চাভিমানিত্বং তথা ত্যাগিত্বমেব চ।
এতে বৈ সপ্ত দোষাঃ স্যুঃ সদা বিদ্যার্থিনাং মতাঃ ॥
সুখার্থিনঃ কুতো বিদ্যা নাস্তি বিদ্যার্থিনঃ সুখম্ ।
সুখার্থী বা ত্যজেদ্বিদ্যাং বিদ্যার্থী বা ত্যজেত্ সুখম্ ॥
(মহাভারত: উদ্যোগ পর্ব, ৪০.৫-৬)
" আলস্য, মত্ততা, মোহ, চাঞ্চল্যের জন্যে সমবেত হওয়া, জড়তা, অভিমান, ও উপেক্ষা এ সাতটা একজন বিদ্যার্থীর দোষ।
সুখার্থীর বিদ্যা লাভ হয় না, বিদ্যার্থীর সুখ লাভ হয় না। অতএব হয় সুখার্থী বিদ্যা ত্যাগ করবে, না হয় বিদ্যার্থী সুখ ত্যাগ করবে।"


একজন বিদ্যার্থীর অবশ্যই আলস্য করা পড়াশোনা সহ নিজের সকল কাজ নিষ্কাকভাবে করে যেতে হবে। যিনি জ্ঞানের পথে চলবেন, সেই বিদ্যার্থীর জীবন থেকে মত্ততাকে পরিত্যাগ করা উচিত। মোহ মানুষকে অন্ধ করে। মোহগ্রস্ত অবস্থায় একজন মানুষ হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। সে তখন তার ভালো মন্দ বিচার করতে পারে না। তাই মোহ যতটা সম্ভব বা পারলে সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করা উচিত। জীবনে চাঞ্চল্যের প্রয়োজন আছে, তবে তা হতে হবে কর্মচাঞ্চল্য। দলবেঁধে বন্ধুদের সাথে সমবেত অতিরিক্ত চঞ্চলতা প্রকাশ করাটা একজন বিদ্যার্থীর জন্যে শোভন নয়।


অতিরিক্ত অপ্রয়োজনীয় চঞ্চলতা বিদ্যার্থীর একাগ্রতা ভয়ংকরভাবে বিনষ্ট করে। গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে চঞ্চলতা এবং অস্থিরতার কারণে অনেকেরই জীবনে পড়াশোনায় ব্যাপকভাবে ক্ষতি হয়। কিছু কিছু বিদ্যার্থীদের সময়কালে সময়ের কাজ পড়াশোনা না করায়, অনেকের পড়াশোনাই সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এই ব্যক্তিরাই পরবর্তীতে জীবনে বুঝতে পারে যে তারা অত্যন্ত ভুল করেছে। অতিরিক্ত চঞ্চলতা যেমন কাম্য নয় তেমনি অতিরিক্ত জড়তাও কোনক্রমেই কাম্য নয়।


সত্যি কথা বলতে, অতিরিক্ত কোন কিছুই ঠিক নয়। জীবনে পরিমিতিবোধটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেকেই বুঝতে পারেন না যে, জীবনের কোথায় কোথায় লাগাম টানবেন। একজন বিদ্যার্থীর অতিরিক্ত অভিমান কাম্য নয়। এ অতিরিক্ত অভিমান থেকে প্রচণ্ড ধরণের আত্ম অহামিকার জন্ম নেয়। সেই আত্মকেন্দ্রীক অহামিকাও যদি যথাযথভাবে লাগাম দেয়া না হয়, তবে সেই অহংকার ঝড়েরবেগে বাড়তে থাকে। একসময়ে গিয়ে সেই অহংকারের গর্ভ থেকেই 'নার্সিসিজম' এর জন্ম নেয়। ধীরেধীরে মানুষ তখন মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। জগতে প্রত্যেকটি মানুষকেই প্রত্যেকটি মানুষের শতভাগ প্রয়োজন আছে। তাই কাউকেই কখনো পরিত্যাগ বা উপেক্ষা করা উচিত নয়।


এই সাতটি বিষয় একজন বিদ্যার্থীর দোষ। এগুলো পরিত্যাগ করা প্রয়োজন। তাই একজন হয় সুখার্থী বিদ্যা ত্যাগ করবে, অথবা বিদ্যার্থী সুখ পরিত্যাগ করবে। অতিরিক্ত সুখভোগের পিছনে দৌড়ানোর পরে মানুষ যদি একদণ্ডও সুখকে বেঁধে রাখতে পারে, তবে দিনশেষে দেখা যায় সেই সেই সুখই প্রচণ্ড দুঃখের কারণ হয়। তখন মানুষ সেই মোহরূপ সুখের মিছরির কারাগার থেকে মুক্তি চায়।এ বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত 'চিত্রাঙ্গদা' নৃত্যনাট্যের মধ্যেও পাওয়া যায়।

চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যের প্রধান চরিত্র চিত্রাঙ্গদা প্রেমিক অর্জুনকে দেখে বলে:

"সুখেরে তাহার বেশি একদণ্ডকাল
বাঁধিয়া রাখিলে, সুখ দুঃখ হয়ে ওঠে।
যাহা আছে তাই লও, যতক্ষণ আছে
ততক্ষণ রাখো। কামনার প্রাতঃকালে
যতটুকু চেয়েছিলে, তৃপ্তির সন্ধ্যায়
তার বেশি আশা করিয়ো না।"
জগতে সুখ এবং বিদ্যা যেন লক্ষ্মী এবং অলক্ষ্মীর মত, তাঁরা এক আসনে বসতে পারে না। হয় আসনে লক্ষ্মী থাকবে, নচেৎ অলক্ষ্মী থাকবে। তেমনিভাবে একজন বিদ্যার্থীর জীবনে হয় বিদ্যার জ্যোতির্ময় আলো থাকবে; অথবা সুখ, আকাঙ্খা এবং ভোগ নামক অজ্ঞানের অন্ধকার থাকবে। দুটির যে কোন একটি থাকে। কিন্তু উভয়কেই সাথে নিয়ে চলা অত্যন্ত দুরূহ।বিষয়টি দুই নৌকায় পা দিয়ে চলার মত। ইচ্ছা থাকলেও চলা যায় না। (বিদ্যার্থীর সুখ হয় না, সুখার্থীর বিদ্যা লাভ হয় না)

Shri Kushal Baran Chakraborty
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url

আপনাদের ক্লিক এই Website টি সচল রাখার অর্থ যোগাবে।