শিক্ষা ব্যবস্থার ইসলামীকরণ (গোড়ায় গণ্ডগোল) | Sojasapta 2 - সোজাসাপ্টা ২
ধরুন, আপনি যদি কাউকে হত্যা করতে চান, বিষপ্রয়োগ করে। এক্ষেত্রে সায়ানাইড বা এই জাতীয় কোন তীব্র বিষ আপনার কাজে লাগবে। কিন্তু ইহার সমস্যা হইতেছে, হত্যাকারী হিসেবে মানুষের সন্দেহ খুব সহজেই আপনার ওপরে বর্তাবে। অন্যদিকে, আপনি যদি খুব অল্প মাত্রায় আর্সেনিক বা এজাতীয় কোন বিষ প্রতিদিন একটু একটু করে আপনার শিকারের ওপরে প্রয়োগ করতে থাকেন, একসময় সে নির্ঘাত মৃত্যুবরণ করবে, এবং কারু সন্দেহের তীরও আপনার ওপরে পড়বে না।
নাহ, আমি কাউকে হত্যা শেখানোর জন্য কলম ধরি নাই। কিন্তু আমার তীব্র সন্দেহ, বাংলাদেশের জাতীয় পাঠ্যক্রমের সঙ্গে জড়িত কর্তাব্যক্তিবর্গ এই ধীর বিষক্রিয়া (Slow Poisoning) পদ্ধতি প্রয়োগ করছেন কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপরে। আসুন কিভাবে তার ব্যাখ্যা প্রদান করি।
আমি গত বছর (২০২১) সালের জাতীয় পাঠ্যক্রমের বিভিন্ন শ্রেণীর বাংলা বইয়ের কন্টেন্টগুলো পরেছিলাম। অবশ্য ২০২২ সাল থেকে নাকি পাঠ্যক্রমের কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। এই সিরিজে সেইগুলোরও আলোচনা হইবে পরবর্তীতে।
শিক্ষিত মানুষ মাত্রই জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে অবগত আছেন। জাপানে ৪র্থ গ্রেড, তথা প্রায় ১০ বছর বয়স পর্যন্ত বিদ্যালয়ে কোন পরীক্ষা নেয়া হয় না[1] । তার পরিবর্তে এই সময়কালে তাদের পড়ানোর পাশাপাশি যে বিষয়টা খুব বেশী করে শেখানো হয়, তা হচ্ছে ব্যবহার। সমাজের মানুষের সাথে কি ভাবে মিশতে হবে, আইন-কানুন কিভাবে মেনে চলতে হবে, সত্য কথা বলতে হবে, নিজের দায়িত্ব পালন করতে হবে। এক কথায় ১০ বছর বয়সের মধ্যেই তাদের সুশীল মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার মন্ত্র মনের মধ্যে দিয়ে দেয়া হয়। এক্ষণে বলে রাখা ভাল, জাপানের অধিকাংশ মানুষই কিন্তু আজ নাস্তিক, কিন্তু তা সত্ত্বেও জাপানের আইন-কানুন ব্যবস্থা বিশ্বের যে কোন ধার্মিক দেশের সঙ্গে যদি তুলনা করেন, তাহলে জাপানই এগিয়ে থাকবে।
এই যে ১০/১২ বছর, বা একটা নির্দিষ্ট সময়, একজন শিশুর জন্য- ইহা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন। একটি শিশুর ভবিষ্যৎ নির্ভর করে মূলত এই সময়ের ওপরেই। সেক্ষেত্রে তার পিতা-মাতা, পরিবার, সমাজ, বন্ধু, শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শিশু যা যা শিখবে, তা তার মনে আমৃত্যু গেঁথে থাকবে। সে জন্য বলা হয়ে থাকে, কোন শিশু রেসিস্ট হয়ে জন্মায় না, হয়তো তার পরিচিত গণ্ডির মধ্যে সে রেসিজম নিয়ে কথা শুনেছে, তাই সেও ধীরে ধীরে রেসিস্ট হয়ে পরে। উন্নত বিশ্বের মনোবিজ্ঞানীরা প্রায়ই মানুষের সাইকোলোজিকাল প্রোফাইল তৈরী করতে গিয়ে দেখতে পান, যাবতীয় সাইকোলোজিকাল সমস্যার মূল শুরু হয় শৈশবে ঘটা ঘটনা গুলো থেকে।
ধান ভানতে শিবের গীত — আমি আপনাদিগকে ইহাই বোঝানোর চেষ্টা করিলাম, শৈশব একজন শিশুর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ সময়। এই সময়ে আপনি যদি তাহাকে মিথ্যা, এবং কুশিক্ষা প্রদান করেন, তবে তাহার প্রতিফলন ঘটবে সেই শিশুর পরবর্তী সময়ে, এবং বৃহৎ পরিসরে সমগ্র জাতির মধ্যে। সেই জন্য জাতীয় পাঠক্রম নীতি নির্ধারকদের খুবই বুদ্ধিদীপ্ত ভাবে প্রতিটি শ্রেণীর বইয়ের কন্টেন্ট সিলেক্ট করতে হয়। বইয়ের রঙ কি হবে, বইয়ে উল্লেখিত প্রতিটি নাম কেমন হবে, কোন লিঙ্গ নির্ধারণ করবে, ছবিগুলোর পোশাকের ধরণ কেমন হবে সব কিছুই অতি গুরুত্বপূর্ণ। অথচ আমার মনে হয়, এই নীতি-নির্ধারকেরা ইচ্ছাকৃত ভাবেই শিশুদের নরম মনে মিথ্যা (বা বিতর্কীত সত্য) ঢুকিয়ে দিচ্ছে।
১ম থেকে ৭ম শ্রেণীর বাংলা বইয়ের কিছু কন্টেন্ট আমি নিচে তুলে ধরলামঃ
এখানে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতে পারেঃ
- বাংলা বইয়ের কন্টেন্ট কি হওয়া উচিত? হতে পারা বাংলার সাহিত্য, হতে পারে বাংলা ভাষার ইতিহাস, হতে পারে বাংলা ভাষার সাথে যুক্ত মনিষীদের জীবনী। এক কথায় যা কিছু বাংলা এবং বাংলা ভাষার সাথে যুক্ত।
- আমার যুক্তি যদি সত্য হয় তাহা হইলে মুহাম্মদের জীবনী কি ভাবে বাংলার সাথে যুক্ত হইতে পারে? মায়ের ভালবাসা গল্পে মুহাম্মদের যে চরিত্রের ছবি আমরা দেখিতে পাই, বাস্তবে কি তাহা সত্য ছিল? মুহাম্মদ একজন যুদ্ধবাজ, এবং হিংস্র প্রকৃতির শাসক বলিলে অত্যুক্তি হইবে না। তাহার যৌনতা, অমুসলিমদের বর্বর ভাবে হত্যা করা প্রতিটি বিষয় কিন্তু বিতর্কিত (controversial). অথচ পাঠ্য বইয়ে, তাও বাংলার মতো বিষয়ে তাহার কথাই, তাহার মহা-মানবিকতাই বারবার করে আসছে।
- ইহা ছাড়াও যে প্রশ্নটি আসে, তিনি শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট ধর্মের জন্য মহামানব। বাকিদের জন্য সাক্ষাৎ যমদূত। অথচ তার জীবনী, তার বানোয়াট গল্প কেন সবাই পড়বে?
- বানোয়াট বললাম, কারণ একটি এমন গল্পের কথা বলতে পারি "মহানবী এবং ইহুদী বুড়ীর গল্প", যে বুড়ী প্রতিদিন মুহাম্মদের রাস্তায় কাঁটা বিছিয়ে রাখতো, এবং একদিন মুহাম্মদ তা দেখতে না পেয়ে নিজে সেবা করে বুড়ীকে সুস্থ করে তোলে। বাস্তবে কোন হাদিসে এই কাহিনীর কোন বর্ণনা নেই যেখানে নবীর জামার বোতাম ছিঁড়ে যাওয়ারও হাদিসে বর্ননা আছে। তাহা হইলে ইহা কি অমুসলিম শিশুদের মনে মুহাম্মদ এবং ইসলাম সম্পর্কে একটি মানবিক ছবি ফুটিয়ে তোলারই প্রয়াস নয়?
- মুহাম্মদই যদি পরতে হবে, তাহলে বৌদ্ধ, জাতক, শ্রীকৃষ্ণ, যীশু কেন নয়?
- খলিফা উমর, আবু-বকররা তো মুহাম্মদের মৃত্যুর পর নিজেদের মধ্যে এবং অমুসলিমদের সাথে ভয়ংকর যুদ্ধ-সংঘাতে জড়িত ছিল। এক কথায় বলা যায়, তারা একেকজন ছিলেন সাক্ষাৎ জল্লাদ। তাদের বর্বরতায় আরব এবং তার আশেপাশের সকল অমুসলিম রাজ্য হয়ে যায় মানুষ শূন্য। তাহলে এমন বিতর্কিত চরিত্র বাংলা বইয়ে কেন?
- (শহীদ) তিতুমীরের কথাই যদি বলি, সেও বিতর্কিত চরিত্র। ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামই যদি তার উদ্দেশ্য ছিল তবে সে কেন ওয়াহাবি মতাদর্শ প্রচার করতো? তিতুমীর যেদিন আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করলেন সেদিনই তার অনুসারীরা পুঁড়ার বাজার আক্রমণ করে মহেশ চন্দ্র ঘোষের একটা গরু ছিনিয়ে নিয়ে সেটি মন্দিরের সামনে কেটে গরুর রক্ত ছিটিয়ে দিল মন্দিরের গায়ে ও বিগ্রহে। লুট করল অসংখ্য হিন্দুবাড়ি, বেশ কজন হিন্দুকে বিবস্ত্র করে মারধর করল। তার জিহাদ যদি শুধু ইংরেজদের বিরুদ্ধেই হয়, তাহলে হিন্দুদের উপর তার এই অত্যাচার কেন?
এইখানেই শেষ নয়, ৭ম শ্রেণীর বাংলা বই (পৃষ্ঠা ৯৮) তে বলা হচ্ছে, তিনি ইসলামের প্রতি বোন ও ভগ্নিপতির দৃঢ়তা দেখে বিস্মিত হয়ে যান। তার মানসিক পরিবর্তন ঘটে। তিনি মুসলমান হওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পরেন এবং নবী করিম (সঃ) এর দরবারে গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন । এই একটি বাক্য যে ৭ম শ্রেণীতে পড়ুয়া এক শিশুর মনে ধর্মান্তরের বিষয়ে গভীর দাগ কাটতে পারে, একথা যদি বলি তাহা কি খুব বেশি বলা হইবে?
বিদ্যালয়ে গিয়াই একজন শিশুকে কোরআন তালাওয়াতে অংশ লইতে হয়, বলা হয় অমুসলিমরা না বললেও চলবে, কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে হইবে। ক্লাসে গিয়া ঘাতক মুহাম্মদ এবং তার উম্মতের মিথ্যা, মনগড়া মানবিক কাহিনী পড়ানো হয়। ক্লাসের শিক্ষক-শিক্ষিকাও কতটা আদর্শ মনের সেই বিষয়েই সন্দেহের স্থান থেকেই যায়, হাজার হইলেও তাহারা এই সিস্টেমেরই অংশ। তারপরে পড়ানো হয়, ইসলামের জন্য ব্যকুলতা, এবং কিভাবে ইসলামে ধর্মান্তরিত হইয়া বেহেস্ত লাভ করা যাইবে। তাহার পরেও যদি আপনি বলেন, বাংলাদেশে ধর্মান্তরের হার এতো বেশী কেন? আমি বলবোঃ
ফুটনোটগুলি