কমিউনিস্টদের নিষ্ঠুরতা, সাঁইবাড়ি হিন্দু পরিবার হত্যাকাণ্ড | Brutality of communists, killing of Saibari Hindu family
সাঁইবাড়ি হত্যাকাণ্ড ছিলো বর্ধমানে ঘটে যাওয়া একটি অন্যতম রাজনৈতিক ধর্মীয় প্রতিহিংসামূলক ঘটনা। বিরোধী-দল সমর্থনের দায়ে ১৯৭০ সালে সাঁইপরিবারের ৩ ভাই ও তাদের গৃহশিক্ষককে CPI(M) এর সদস্যবৃন্দদের হাতে নিজগৃহে নির্মমভাবে হত্যাকান্ডের শিকার হতে হয়। ৫১ বছর আগে ঘটা সাঁইবাড়ি হত্যাকান্ড-কে আজো ইতিহাসে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সহিংসতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পার্টির দৃঢ় সমর্থক হিসেবে সাঁইপরিবারের ৩ ভাইয়েরা সুপরিচিত ছিলো। তাদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, ৭০ এর দশকে কংগ্রেস-বামদলের সম্মিলিত জোট ইউনাইটেড ফ্রন্টের ভাঙনের প্রাক্কালে সাঁইপরিবারের ভাইয়েরা দল-বদলের জন্য CPI(M)-এর পক্ষ থেকে চাপ পেতে থাকে। কিন্তু দল-বদলের পরিবর্তে উল্টো রাজনৈতিক বাঁধা সৃষ্টি করার প্রতিশোধে ১৯৭০ সালের ১৭ই মার্চ CPI(M) সমর্থিত কিছু উন্মত্ত দলবদ্ধ লোক সাঁইপরিবারের ঘরে ঢুকে সবাইকে অন্যায়ভাবে নিপীড়ন করতে আরম্ভ করে।
ঘটনার সূত্রপাত ঐ ধর্মঘটের দিন সিপিআইএম সমর্থিত আদিবাসীদের একটি মিছিলকে কেন্দ্র করে। অভিযোগ, ঘটনার দিন সাঁই-পরিবারের মেজো ভাই প্রণব সাঁইকে সকালের জলখাবার খাওয়ারত অবস্থাতেই পেছন থেকে আক্রমণ করে হত্যা করা হয়। সাঁই-পরিবারের ছোট ভাই মলয় সাঁই প্রাণে বাঁচার জন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রতিবেশীদের ঘরে আশ্রয় নিতে চাইলে, তাকে ধরে এনে CPI(M) সমর্থিত লোকরা হত্যা করে বলে অভিযোগ।
ছেলেদের মারার সময় বাঁধা দিতে গেলে সাঁইভাইদের মা মৃগনয়না দেবীকেও মাথায় আঘাত করে। পরে আক্রমণকারীদের দুজন প্রণব - মলয় ভার্তৃদ্বয়-কে হত্যার পর তাদের রক্ত দিয়ে ভাত মিশিয়ে তাদের মা মৃগনয়না দেবীকে সেই রক্তমাখা ভাত খেতে বাধ্য করে। আরো অভিযোগ, সাঁই -পরিবারের বড়ভাই নবকুমার সাঁইও এই ঘটনা থেকে নিস্তার পান নি।পরবর্তী বছরে তাকেও একই পরিণতি বরণ করতে হয়। হত্যার পূর্বে CPI(M) ক্যাডার-রা অ্যাসিড দিয়ে চোখ ঝলসানোর পর তার চোখ উপড়ে ফেলে।কংগ্রেস এবং সাঁই পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, পুরো ঘটনাটি ঘটিয়েছিল CPI(M) ক্যাডাররা, কারণ পরিবারটির সমর্থন ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতি এবং ভুক্তভোগীরা CPI(M) এর প্রতি আনুগত্য পরিবর্তন করতে অস্বীকার করেছিল।
সেদিনকার ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সাঁইবাড়ির বড়ছেলে নবকুমার সাঁইয়ের স্ত্রী বর্তমানে ৭২ বছর বয়সী রেখারাণী দেবী ভারতের প্রথমসারির দৈনিক দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেনঃ
আমার দেবর প্রণব আর মলয় এবং আমার মেয়েদের গৃহশিক্ষক জিতেন্দ্রনাথ রায়, যিনি সেদিন বাড়িতে পড়াতে এসেছিলেন, এই ৩ জনকে নিজ চোখের সামনেই খুন হতে দেখেছি। আমার বয়স ছিলো তখন ২৬। সকাল ৭ঃ৩০ টায় সিপিআই(এম) এর লোকেরা আক্রমণ চালাতে শুরু করে। আক্রমণের প্রথম দিকে তারা পাথর ছুঁড়ে মারলেও, পরে পুরো বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
তিনি আরো জানানঃ
প্রাণপণে চেষ্টা করছিলাম আমার শ্বাশুড়ি মৃগনয়না দেবীকে আগলে রাখতে। কিন্তু তিনি তাঁর ছেলেদের আক্রমণ থেকে বাঁচাতে গেলে আক্রমণকারীরা তার মাথায় আঘাত করে বসে। পরে আক্রমণকারীদের দু’জন ভাতের সাথে তার ছেলেদের রক্ত মিশিয়ে তা খেতে বাধ্য করে। ঘটনার পরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে বাঁচানো হয়।
সাঁই-পরিবারের মেয়ে স্বর্ণলতা যশও সেদিনকার নৃশংস ঘটনার সাক্ষী ছিলেন। স্বর্ণলতার একমাস বছর বয়সী ছেলে অমৃতকুমার যশের ষষ্ঠীর অনুষ্ঠানের আয়োজনের দিনই এই আক্রমণ চালানো হয়। অভিযোগ করা হয়, সিপিআই(এম) এর উন্মত্ত আক্রমণকারীরা নবযাতক শিশুকেও আগুনে ছুঁড়ে দিতে চেয়েছিলো। পরে স্থানীয়দের সহায়তায় নবযাতক বেঁচে যায়।
সেদিনকার সেই নবযাতক, বর্তমানে ৫১ বছর বয়সী অমৃতকুমার যশ ভারতের আরেক প্রথমসারির দৈনিক দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া-কে দেওয়া ২০১১ সালের এক সাক্ষাৎকারে বলেনঃ
আমি সেদিনই মারা যেতে পারতাম। কিন্তু পরিবারের বাকি সদস্যদের মতো আমিও সেই একই মানসিক-ক্ষত আজও বয়ে বেড়ায়। এটি সত্যি দূর্ভাগ্যজনক যে আমরা আজও সেই একই পার্টি দ্বারা শাসিত হচ্ছি, যাদের শাসন-ক্ষমতার মূলমন্ত্রই হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ!