Translate

প্রতিমা প্রাকৃতিক উপাদানের হতে হয় | The idol should be made of natural material

What is so special about Durga Puja?,Durga Puja,durga puja near me,durga puja 2022 bay area,sanskriti durga puja 2022,durga puja 2023,dussehra 2022,navratri 2022,mahalaya 2022,durga puja 2022 bangladesh,durga puja koto din baki,durga puja 2021 bangladesh,upcoming puja 2022,durga puja ashtami 2022,durga puja 2021


বেদে পরমেশ্বরের মূর্ত এবং অমূর্ত দুটি রূপেরই কথা বলা আছে। ঈশ্বর সাকারও না, নিরাকারও না ; তিনি চিন্তার অতীত একটা সত্ত্বা। ঈশ্বর কোন পাঁচতলা, সাততলা, দশতলা আকাশের উপরে পাপপুণ্যের ক্যালকুলেটর হাতে নিয়ে আরামচেয়ারে নিষ্ঠুরচিত্তে বসে নেই। তিনি সর্বত্র বিরাজিত, প্রত্যেকটি জীবের হৃদয়ে বিরাজিত, প্রত্যেকটি বস্তুতে বিরাজিত। তিনি দয়াময়, মায়াময় এবং প্রেমময়।


দ্বে বাব ব্রহ্মণো রূপে মূর্তং চৈবামূর্তং

চ মর্ত্যং চামৃতং চ স্থিতং চ যচ্চ সচ্চ ত্যচ্চ।।

(বৃহদারণ্যক উপনিষদ:২.৩.১)

"ব্রহ্মের দুইটি রূপ, মূর্ত(মূর্তিমান) ও অমূর্ত(অমূর্তিমান), মর্ত্য ও অমৃত, স্থিতিশীল ও গতিশীল, সৎ (সত্তাশীল) ও ত্যৎ (অব্যক্ত)।"

ভক্তকবি রজনীকান্ত সেন ঈশ্বরের মূর্ত-অমূর্ত, অরূপ-সরূপ, সগুণ নির্গুণ,দয়াল-ভয়াল সহ বিবিধ পরস্পর বিরোধী ভাবের একত্র সম্মিলন তাঁর একটি ব্রহ্মসংগীতে অত্যন্ত সুন্দর করে বর্ণনা করেছেন।

"তুমি, অরূপ সরূপ, সগুণ নির্গুণ,

দয়াল ভয়াল, হরি হে; -

আমি কিবা বুঝি, আমি কিবা জানি, 

আমি কেন ভেবে মরি হে।"


একাধারে জগতের বিবিধ ভাবের সাথে যুক্ত এবং এর বিপরীতে সকল ভাবের অতীত, চিন্তার অতীত পরমেশ্বরকে নিরাকারভাবে উপাসনা করতে পারি। নিরাকারভাবে উপাসনায় প্রধানত ওঙ্কারকে অবলম্বন করেই পরমেশ্বরের পথে অগ্রসর হতে হয়। তেমনি সাকারভাবেও বিভিন্ন রূপ এবং প্রতিমাকে অবলম্বন করে ঈশ্বরের পথে অগ্রসর হতে পারি। সাকার পথটি তুলনামূলক সহজ। নিরাকার পথটি বেশ কষ্টসাধ্য। শাস্ত্রে বিভিন্ন অপচনশীল কৃত্রিম উপাদানে দেবপ্রতিমা তৈরিতে নিষেধ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে কি কি প্রকৃতিজাত উপাদানে প্রতিমা তৈরি হবে তাও সুস্পষ্টভাবে বেদ, শ্রীমদ্ভাগবত সহ বিভিন্ন শাস্ত্রে নির্দেশনা দেয়া আছে। তাই সেই নির্দেশনা অনুসরণ করেই দেববিগ্রহাদি তৈরি করা উচিত। 


ইতিহাস পড়তে ক্লিক করুন

শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণে প্রতিমা নির্মাণ বিষয়ক অষ্টবিধ প্রাকৃতিক উপকরণের কথা বলা হয়েছে:


শৈলী দারুময়ী লৌহী লেপ্যা লেখ্যা চ সৈকতী।

মনোময়ী মণিময়ী প্রতিমাষ্টবিধা স্মৃতা।।

(শ্রীমদ্ভাগবত:১১.২৭.১২)

"আমার পূজা অষ্টবিধ উপকরণে নির্মিত যে কোন প্রতিমায় বিধেয়। এ অষ্টবিধ উপকরণ হল: পাথর, কাঠ,ধাতু, মাটি, চিত্রপট, বালুকা,মনোময়, মণিময়।"


শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণের মত অগ্নিপুরাণেও সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে যে, কি কি উপাদানে দেবপ্রতিমা নির্মাণ করা যায়। অগ্নিপুরাণে সাতটি উপাদানের কথা বলা হয়েছে। সে সাতটি উপাদানের নামের মধ্যে শুধু দুটি উপাদান ছাড়া সকল উপাদানের নামই শ্রীমদ্ভাগবতে পাওয়া যায়। পদ্মপুরাণে নতুন দুটি উপাদান হল গন্ধময়ী বা গন্ধদ্রব্যাদি দ্বারা নির্মিত প্রতিমা এবং কুসুমময়ী বা ফুলের তৈরি প্রতিমা। 


মৃণ্ময়ী দারুঘটিতা লোহজা রত্নজা তথা ॥ 

শৈলজা গন্ধজা চৈব কৌসুমী সপ্তধা স্মৃতা। 

কৌসুমী গন্ধজা চৈব মৃণ্ময়ী প্রতিমা তথা ॥  

তৎকালপুজিতাশ্চৈতাঃ সৰ্বকামফলপ্ৰদাঃ। 

(অগ্নিপুরাণ: ৪৩.৯-১১)

"মৃণ্ময়ী, দারুময়ী, লোহময়ী, রত্নময়ী, শৈলময়ী, গন্ধময়ী ও কুসুমময়ী, এই সাতপ্রকার প্রতিমা শাস্ত্রে নির্দিষ্ট রয়েছে। এরমধ্যে মৃণ্ময়ী, গন্ধময়ী ও কুসুমময়ী প্রতিমা পুজিত হয়ে তৎকালমাত্রে সৰ্বপ্রকার কামনা এবং ফল প্রদান করে থাকে।"


 গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, অগ্নিপুরাণের   গন্ধদ্রব্যাদি দ্বারা নির্মিত প্রতিমা এবং  ফুলের তৈরি প্রতিমার বিষয়টি শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের অষ্টবিধ উপকরণের মধ্যেও নিগূঢ়ভাবে রয়েছে। যেমন গন্ধদ্রব্যাদি মৃত্তিকা বা ভূমিরই অন্তর্ভুক্ত এবং ফুল দারু বা বৃক্ষের অন্তর্ভুক্ত । কারণ বৃক্ষ বা দারু থেকেই ফুলের জন্ম হয়। বৃক্ষ না হলে ফুল ফুল জন্মলাভ করতে পারে না। ফুল দিয়ে প্রতিমার অবয়ব তৈরি করে পূজা করার বিষয়টি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের আদিবাসী সমাজে ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়। ফুলকে দেবতার প্রতিমা হিসেবে ব্যবহার করার বিষয়টি দুর্গাপূজারর সময়ে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝেও দেখা যায়। বিশেষ করে, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে। দুর্গাপূজার অনুষ্ঠানে বিজয়া দশমীর দিন দশমীবিহিত পূজার শেষে ঘট বিসর্জনের পর ঈশানকোণে অষ্টদল পদ্ম অঙ্কন করে , সেই অষ্টদল পদ্মের উপরে অপরাজিতা ফুল গাছের লতা রেখে দেবী অপরাজিতা দুর্গাকে পূজা করার রীতি পশ্চিমবঙ্গসহ বঙ্গের বহু অঞ্চলেই প্রচলিত। দেবী অপরাজিতা দুর্গার সাথে নামের সাদৃশ্যের জন্যই অপরাজিতা ফুল গাছের লতাকে দেবীর স্বরূপে পূজা করা হয়। 



দেবীপ্রতিমা তৈরির উপাদান সম্পর্কে দেবীপুরাণে বলা হয়েছে:


মাতৃণাং প্রবরাং দেবী সর্বদেবনমস্কৃতা।

হৈমা বা রত্নবার্ক্ষা বা শৈলা বা চিত্রজাপি বা।

স্থাপ্যা পূর্ববিধানেন সর্বকামপ্রসাধনী।।

(দেবীপুরাণ: ৫০.৩৭)

"দেবী মাতৃগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠা এবং সর্বদেবতার পূজনীয়া।স্বর্ণময়ী, রত্নময়ী, কাষ্ঠময়ী, শৈলময়ী কিংবা চিত্রময়ী, যে কোন মূর্তি পূর্বোক্ত বিধান অনুসারে স্থাপন করলে সর্ব কামনার ফল সিদ্ধ হয়।"


মাটির তৈরি মৃণ্ময়ী, গন্ধময়ী ও কুসুমময়ী প্রতিমায় পূজা করলে, তৎকালমাত্রেই সৰ্বপ্রকার অভীষ্ট ফল প্রদান করে। এর বড় দৃষ্টান্ত শ্রীচণ্ডীতেই দেখতে পাওয়া যায়। শ্রীচণ্ডীতেও সমাধি বৈশ্য এবং রাজা সুরথ মাটির মৃন্ময়ী প্রতিমা তৈরি করে দেবীকে পূজা করেছিলেন।সেই মৃন্ময়ী প্রতিমার আরাধনায় দেবী প্রসন্ন হয়ে সমাধি বৈশ্য এবং রাজা সুরথের সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে তাদের সকল মনবাসনা পূর্ণ করেছিলেন।

 

স চ বৈশ্যস্তপস্তেপে দেবীসূক্তং পরং জপন্।

তৌ তস্মিন্ পুলিনে দেব্যাঃ কৃত্বা মূর্তিং মহীমহীম্।।

(শ্রীচণ্ডী:১৩.১০)

"রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য জগন্মাতার দর্শন লাভমানসে নদীতীরে অবস্থান করে শ্রেষ্ঠ দেবীসূক্ত পাঠ ও অনুধ্যান করতে করতে তপস্যারত হলেন। তাঁরা উভয়ে সেই নদীতটে দুর্গাদেবীর মৃন্ময়ী প্রতিমা নির্মাণ করলেন।"


শ্রীচণ্ডীতে বর্ণিত মৃন্ময়ী প্রতিমাতে সমাধি বৈশ্য এবং রাজা সুরথ যে পূজা করেছিলেন। আজও সেই অবিছিন্ন পরম্পরায় দেবীকে মাটির মৃন্ময়ী প্রতিমাতেই আরাধনা করা হয়। আমাদের ঐতিহ্য এবং উৎসবের কোন উপাদানই নবীন নয়; বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজও বহমান। আলেখ্য চিত্রপটও অত্যন্ত সহজলভ্য; তাই অত্যন্ত জনপ্রিয়। সমুদ্রের বালুকাতেও শিবলিঙ্গ সহ বিবিধ প্রতিমা তৈরি করে পূজা করা যায়। পূর্বে বিভিন্ন রাজাগণ মণিমাণিক্যের দেববিগ্রহ স্থাপন করে পূজা করতেন। এই সাতটি অন্য একটি উপাদান হল মনোময়ী বিগ্রহ। 


অর্থাৎ সাতটি উপাদানে যেমন ভগবদবিগ্রহাদি তৈরি করে সাকার মূর্তিতে বিবিধ উপাচারে তাঁর উপাসনা করতে পারি।তেমনি সম্পূর্ণ হৃদয়ের শুদ্ধ ভাবকে অবলম্বন করে হৃদয়মণ্ডলে পরমেশ্বরের প্রতিমা তৈরি করে তাঁর উপাসনা কর‍তে পারি। পরমেশ্বর মূর্তমান, অমূর্তমান সকল ভাবে এবং স্বরূপেই বিরাজিত। শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণিত প্রতিমার উপাদানগুলোর উপাদানগুলো আমরা শুক্ল যজুর্বেদেও পাই। যজ্ঞ বলতে বর্তমানে আমরা আগুন জ্বালিয়ে তাতে হবি সমর্পণকেই বুঝি। কিন্তু যজ্ঞের অর্থ আরও ব্যাপক, ভগবানকে উপাসনা এবং তাঁর সন্তুষ্টির জন্য যে কর্ম তাকেও যজ্ঞ বলে। শ্রীমদভগবদগীতার চতুর্থ অধ্যায়েও জ্ঞানযজ্ঞ, দানযজ্ঞ, দ্রব্যযজ্ঞ সহ বিবিধ প্রকারের যজ্ঞের সম্পর্কে বলা হয়েছে। শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতাতেও পাথর, মাটি, পাহাড়, বৃক্ষ, বিবিধ ধাতুর দ্বারা যজ্ঞ সুসম্পন্ন করার কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। 


অশ্মা চ মে মৃত্তিকা চ মে গিরয়শ্চ মে পর্বতাশ্চ

মে সিকতাশ্চ মে বনস্পতয়শ্চ মে হিরণ্যং 

চ মেঽযশ্চ মে শ্যামং চ মে লোহং চ মে সীসং

চ মে ত্রপু চ মে যজ্ঞেন কল্পতাম্।।

(শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতা: ১৮.১৩)

"প্রস্তর, মৃত্তিকা, গিরি, পর্বত, বালুকা,বৃক্ষ-বনস্পতি সুবর্ণ, রৌপ্য, তাম্র, লৌহ, সীসা, ত্রপু(রঙ্গ বা রাং) -এগুলোর দ্বারা আমার যজ্ঞ সুসম্পন্ন হোক।"

ইতিহাস পড়তে ক্লিক করুন

কিন্তু বর্তমানে ককশিট, ফাইবার সহ এমন অনেক কৃত্রিম উপাদানে প্রতিমা তৈরি করা হয় যা, জলে বিসর্জিত হলেও জলের সাথে মিশে যায় না। এ সকল কৃত্রিম উপাদানের তৈরি প্রতিমায় পূজা অশাস্ত্রীয়।ভগবানের পূজার প্রতিমা এবং বিগ্রহ কোন প্রাকৃতিক উপাদানে হতে হবে। সেই প্রাকৃতিক উপাদানটি বিভিন্ন প্রকারের শিলা বা পাথরের হতে পারে। পাথরটি খোদাই করে প্রতিমাও তৈরি করে যেমন পূজা করা যায় ; তেমনি নারায়ণ শিলা, গিরি গোবর্ধন শীলা অথবা বাণলিঙ্গের মত প্রকৃতিতে প্রাপ্তরূপেই পূজা করা যেতে পারে। কাঠের বিগ্রহকে দারুবিগ্রহ বলে। বিভিন্ন কাঠে বিগ্রহাদি তৈরি হয়, এরমধ্যে চন্দন কাঠের বিগ্রহ অন্যতম। পুরির জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলভদ্র এবং তাঁদের সাথে সুদর্শন বিগ্রহ নিমকাঠে তৈরি হয়। বাংলায় সেই পরম্পরা অনুসরণ করে জগন্নাথ বিগ্রহ সহ অধিকাংশ বৈষ্ণব মন্দিরের বিগ্রহাদি নিমকাঠের তৈরি। 


এদের মধ্যে বিষ্ণু, শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীচৈতন্য, শ্রীনিত্যানন্দ বিগ্রহ অন্যতম। জগন্নাথ বিগ্রহ কাঠের হওয়ায়, সেই বিগ্রহকে 'দারুব্রহ্ম' বলা হয়। সোনা, কাসা, পিতল, তামা সহ অধিকাংশ ধাতুতেই দেববিগ্রহ তৈরি হয়। এর মধ্যে সৌন্দর্য এবং দীর্ঘস্থায়ীত্বের জন্যে অষ্টধাতু নির্মিত বিগ্রহ অন্যতম। বাংলার অধিকাংশ সম্ভ্রান্ত পরিবারে অষ্টধাতুর রাধাকৃষ্ণ বা লক্ষ্মীনারায়ণ বিগ্রহ পূজিত হতে দেখা যায়। শাস্ত্রে বর্ণিত প্রতিমা তৈরির অষ্ট উপাদানের মধ্যে অন্যতম সহজলভ্য উপাদান হল মাটির তৈরি মৃন্ময়ী প্রতিমা। বাংলায় প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা, কালীপূজা, সরস্বতী পূজা সহ অধিকাংশ পূজাতেই মৃন্ময়ী প্রতিমা পূজিত হয়। 


কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 

সহকারী অধ্যাপক, 

সংস্কৃত বিভাগ, 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url

আপনাদের ক্লিক এই Website টি সচল রাখার অর্থ যোগাবে।