Translate

নারীর মাঝেই দেবীর স্বয়ং প্রকাশ | The self-manifestation of the goddess is within the woman

The self-manifestation of the goddess is within the woman


শ্রী চণ্ডীর একাদশ অধ্যায়ে ইন্দ্র, অগ্নি প্রমুখ দেবতারা দেবী কাত্যায়নী দুর্গা কর্তৃক অসুররাজ শুম্ভ নিহত হলে প্রফুল্ল বদনে সকল দিক উদ্ভাসিত করে দেবীর স্তব করেন। সে স্তবে দেবীর বিভূতি প্রসঙ্গে বলা হয়, জগতের সকল জীবের মাঝেই তিনি আছেন; কিন্তু নারীর মাঝেই তাঁর স্বয়ং রূপের প্রকাশ। 


বিদ্যাঃ সমস্তাস্তব দেবি ভেদাঃ।

 স্ত্রিয়ঃ সমস্তাঃ সকলা জগৎসু ।

ত্বয়ৈকয়া পূরিতমম্ য়ৈতৎ

কা তে স্তুতিঃ স্তব্যপরাপরোক্তিঃ ॥ 

(শ্রীচণ্ডী:১১.৬)

"হে দেবি, বেদাদি অষ্টাদশ বিদ্যা আপনারই অংশ। চতুঃষষ্টি-কলাযুক্তা এবং পাতিব্রত্য, সৌন্দর্য ও তারুণ্যাদি গুণান্বিতা সকল নারীই আপনার বিগ্রহ। আপনি জননীরূপা এবং একাকিনীই এই জগৎকে অন্তরে ও বাইরে  পরিব্যাপ্ত করে আছেন। যখন আপনি স্বয়ং স্তবনীয় বিষয়ে মুখ্য ও গৌণ উক্তিরূপা, তখন আপনার এইরূপ স্তুতি আর কী হতে পারে?"


নারীর মাঝেই দেবীর স্বয়ং প্রকাশ। তাই দুর্গাপূজাসহ অধিকাংশ তন্ত্রোক্ত দেবীপূজায় দেবীকে প্রতিমায় আহ্বান করার সাথে সাথে নিষ্পাপ কুমারী রূপেও পূজা করা হয়। কুলাচার অনুসারে দুর্গাপূজায় কোথায় মহাঅষ্টমী তিথিতে, আবার কোথাও মহানবমী তিথিতে দেবী প্রতিমার সম্মুখে  দেবীর জীবন্তবিগ্রহ হিসেবে একটি কুমারী নারী শিশুকে পূজা করা হয়। গণেশাদি পঞ্চদেবতার পূজা সম্পন্ন করে, পরবর্তীতে কুমারী পূজা করতে হয়। শাস্ত্রে বিভিন্ন বয়সের কুমারীর বিবিধ নামকরণ করা হয়েছে। তিন বছরের কুমারীর নাম ত্রিধামূর্তি; চার বছরের কুমারীর নাম কালিকা;  পাঁচ বছরের কুমারীর নাম সুভগা; ছয় বছরের কুমারীর নাম উমা;  সাত বছরের কুমারীর নাম মালিনী;  আট বছরের কুমারীর নাম কুব্জিকা; নয় বছরের কুমারীর নাম কালসন্দর্ভা; দশ বছরের কুমারীর নাম অপরাজিতা;  এগারো বছরের কুমারীর নাম রুদ্রাণী ; বারো বছরের কুমারীর নাম ভৈরবী এবং তেরো বছরের কুমারীর নাম মহালক্ষ্মী। 


তেরো বছরের ঊর্ধ্ববয়স্কা নারী শিশুকে কুমারীরূপে পূজা না করাই বিধেয়। কুমারীর ধ্যান হল:


ওঁ বালরূপাঞ্চ ত্রৈলোক্যসুন্দরীং বরবর্ণিনীম্।

নানালঙ্কারভূষাঙ্গীং ভদ্রবিদ্যাপ্রকাশিনীম্।।

চারুহাস্যাং মহানন্দহৃদয়াং শুভদাং শুভাম্।।

ধ্যায়েৎ কুমারীং জননীং পরমানন্দরূপিণীম্।।

"বালিকারূপিণী, ত্রিভুবনের মধ্যে সুন্দরী, শ্যামা, নানা অলঙ্কারে যাঁর অঙ্গ ভূষিত, যিনি শুভবিদ্যাদান করেন, সুস্মিতা, পরম আনন্দে যাঁর হৃদয় পরিপূর্ণ, মঙ্গলদায়িনী, নিজে মঙ্গলময়ী—সেই ব্রহ্মস্বরূপিণী জননী কুমারীকে চিন্তা করি।"


ধ্যানমন্ত্রে দেবীকে আহ্বান করে আসন, স্বাগত, পাদ্য, অর্ঘ্য, আচমনীয়, মধুপর্ক, পুনরাচমনীয়, গন্ধতৈল, স্নানীয়, বস্ত্র, আভরণ, সিন্দূর, অলতা, চোখের কাজল, আয়না, চিরুনী প্রভৃতি প্রাসাধনদ্রব্য, মাল্য, গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য, পানীয়, পুনরাচমনীয় এবং তাম্বুল ইত্যাদি ষোড়শোপচারে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে দেবীর পূজা করতে হয়। বয়স অনুসারে কুমারীর নাম নিশ্চিত হয়ে- "এতৎ সম্প্রদানায় ঐং হ্রীং শ্রীং হূং হেঁসৌঃ কুমাৰ্য্যৈ নমঃ" মূলমন্ত্রে ক্রমানুসারে সকল উপচার নিবেদন করতে হয়।বঙ্গদেশে কুমারী পূজার প্রচলন নবীন নয়। প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন শক্তিপূজায় কুমারীপূজার বিধান পাওয়া যায়। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে লিপিকৃত 'কুমারীপূজাপ্রয়োগ' নামক একটি হস্তলিখিত পুঁথি (সংগ্রহ-১৫৯) ঢাকার বাংলা একাডেমীর সংগ্রহশালায়। অবশ্য পুঁথিটি লিখিত হওয়ার তারিখ ১৮৫০ হলেও, পুঁথিটি নবীন নয়।

কুলসাধক সর্বদা কুমারীপূজনে ভক্তিমান হবে। কুব্জিকাতন্ত্রে কুমারীকে দেবীজ্ঞানে অন্ন, জল, বস্ত্র এবং পূজার বিবিধ প্রকারের উপকরণ প্রদানের মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, কুমারী পূজার কালে কুমারী কন্যাকে পূজার উপকরণ হিসেবে  অন্ন, বস্ত্র, জলদান করতে হয়। কুমারী পূজায় কুমারীরূপ দেবীর সম্মুখে প্রদেয় অন্ন মেরুপর্বতের সমান হয়ে যায়। কুমারীকে প্রদত্ত জল সাগর সমান হয়ে, বস্ত্র অনন্ত কোটি সমান হয়ে এবং পূজার বিভিন্ন প্রকারের উপকরণ সহস্র কোটিগুণে বর্ধিত হয়ে শিবলোকে দেবীর সম্মুখে পৌঁছে যায়।


কুলাস্ত্রিয়ং মহাদেবি তন্ত্রমন্ত্রবিশারদাম্ ।   

দূতীযাগ-রাতাঞ্চৈব বেশ্যাং বা পুংশ্চলীং তথা ।।

বৃদ্ধাং বা যুবতীং বাপি নমস্কুৰ্য্যাদ্ বরাননে।  

কুমারীপূজনে চৈব সদা ভক্তিযুতো ভবেৎ।। 

পঞ্চবর্ষং সমারভ্য যাবৎ দ্বাদশবার্ষিকী । 

কুমারী সা ভবেদ্দেবি নিজরূপ-প্রকাশিনী ।। 

ষষ্ঠবর্ষং সমারভ্য যাবচ্চ নববার্ষিকী ।

তাবচ্চৈব মহেশানি সাধকাভীষ্টসিদ্ধিদা ।।

অষ্টবর্ষং সমারভ্য যাবৎ ত্রয়োদশবার্ষিকী।

কুলজাং তাং বিজানীয়াৎ তন্ত্র পূজাং সমাচরেং ।।

দশবর্ষং সমারভ্য যাবৎ ষোড়শবার্ষিকী । 

যুবতীং তাং বিজ্ঞানীয়াৎ দেবীতুল্যাং বিচিন্তয়েৎ।।

অন্নং বস্ত্রং তথা নীরং কুমার্য্যৈ যো দদাতি হি ।

অন্নং মেরুসমং দেবি জলঞ্চ সাগরোপমম্ ৷৷

বস্ত্ৰৈঃ কোটিসহস্রৈস্তু শিবলোকে মহীয়তে।  

পূজোপকরণঞ্চৈব কুমাৰ্য্যৈ যো দদাতি হি।। 

(কুব্জিকাতন্ত্র: ৭.৩৪-৪১)

"হে মহাদেবি । কুলস্ত্রী তন্ত্রমন্ত্র-রতা এবং দূতীযাগ-রতা হলে, সে বেশ্যা বা পুংশ্চলী, বৃদ্ধা বা যুবতী যে নারীই হোক না কেন তাঁকে নমস্কার করবে ।কুলসাধক সর্বদা কুমারীপূজনে ভক্তিমান হবে। 

 পঞ্চম বর্ষ হতে আরম্ভ করে দ্বাদশ বর্ষ বয়ঃক্রম পর্য্যন্ত কন্যাকে কুমারী বলা হয়। এই সময় সে নিজরূপ প্রকাশ করে । 

হে মহেশানি। ষষ্ঠ বছর হতে নবম বছরের বয়স্কা কুমারী সাধকের অভীষ্টদায়িকা হয়ে থাকে। 

 অষ্টমবছর হতে আরম্ভ করে ত্রয়োদশ বছরের কন্যাকে কুলজা জ্ঞানে পূজা করবে।

দশবছর  হতে ষোড়শবর্ষী যুবতী কুমারী কন্যাকে দেবীতুল্য চিন্তা করবে। 

কুমারী পূজার কালে কুমারী কন্যাকে পূজার উপকরণ হিসেবে  অন্ন, বস্ত্র, জলদান করা হয়। সেই অন্ন মেরুপর্বত সমান হয়ে, সেই জল সাগর সমান হয়ে,  সেই দানকৃত বস্ত্র অনন্ত কোটি সমান হয়ে এবং পূজার বিভিন্ন প্রকারের উপকরণ সহস্র কোটিগুণে গুণিত হয়ে শিবলোকে দেবীসমীপে গমন করে।"



মনুসংহিতায় মহর্ষি মনু বলেছেন, নারী পূজ্যা, সমাদরনীয়া, ভূষনীয়া, সম্মাণীয়া ও বংশের শ্রীবৃদ্ধির প্রধান কারণ। যদি কেউ বহু কল্যাণের আকাঙ্ক্ষা করে, তবে গৃহের কন্যাদিগকে ভোজনাদির দ্বারা পূজা বা সন্তুষ্ট করবে এবং বস্ত্র অলঙ্কারাদির দ্বারা ভূষিত করবে।যে বংশে নারীরা বস্ত্রালঙ্করাদি দ্বারা পূজা বা সমাদর প্রাপ্ত হয়, সেখানে দেবগণ প্রসন্ন হয়ে থাকেন। পক্ষান্তরে যে বংশে স্ত্রীলোকেরা সন্তুষ্ট থাকে, সেই বংশ নিশ্চিতভাবেই শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে। এবং দেবতারাও সেই বংশের প্রতি প্রসন্ন হয়। কিন্তু ভগিনী, পত্নী, পুত্রবধূ প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরা যে বংশে অনাদৃত, অপমানিত সেই বংশ বিষপান করা ব্যক্তির ন্যায় ধন-পশু প্রভৃতিসহ সর্বতোভাবে বিনাশপ্রাপ্ত হয়।দেবতারাও সেই বংশের প্রতি রুষ্ট হন।


পিতৃভির্ভ্রাতৃভিশ্চৈতাঃ পতিভির্দেবরৈস্তথা। 

পূজ্যা ভূষয়িতব্যাশ্চ বহুকল্যাণমীপ্সুভিঃ।।

যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ। 

যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ।।

শোচন্তি জাময়ো যত্র বিনশ্যন্ত্যাশু তৎ কুলম্। 

ন শোচন্তি তু যত্রৈতা বর্দ্ধতে তদ্ধি সর্বদা।। 

জাময়ো যানি গেহানি শপন্ত্যপ্রতিপূজিতাঃ।।

তানি কৃত্যাহতানীব বিনশ্যন্তি সমন্ততঃ।।

তস্মাদেতাঃ সদা পূজ্যা ভূষণাচ্ছাদনাশনৈঃ।

ভূতিকামৈর্নরৈর্নিত্যং সত্কারেষূৎসবেষু চ।।

(মনুসংহিতা:৩.৫৫-৫৯)

"বিবাহসময়ে পতিই কেবল কন্যাকে ধনাদি দিবেন এমন নয়, বিবাহোত্তর কালেও পিতা, ভ্রাতা, পতি, দেবর ইহারা সকলেই যদি বহুকল্যাণরাশির অভিলাষী হয়, তবে ঐ কন্যাদিগকে ভোজনাদির দ্বারা পূজা করবে ও বস্ত্র অলঙ্কারাদির দ্বারা ভূষিত করবে।

যে বংশে নারীরা বস্ত্রালঙ্করাদি দ্বারা পূজা বা সমাদর প্রাপ্ত হন, সেখানে দেবগণ প্রসন্ন হয়ে থাকেন এবং দেবতারা প্রসন্ন হলে পরিবারের সবাই অভীষ্ট ফল প্রাপ্ত হয়। অন্যথা যে বংশে নারীরা সমাদরনীয় নয়, সে গৃহে যাগ,হোম, দেব আরাধনাদি সমস্ত ক্রিয়াই নিষ্ফল হয়ে যায়।

যে বংশে ভগিনী ও গৃহস্থের সপিণ্ড স্ত্রী, কন্যা, পুত্রবধূ প্রভৃতি নারীরা ভূষণ-আচ্ছাদন-অন্নাদির অভাবে দুঃখিনী হয়, সেই বংশ অতিশীঘ্র ধ্বংস প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ দৈব ও রাজাদের দ্বারা পীড়িত হয়।পক্ষান্তরে যে বংশে নারীরা ভোজন-আচ্ছাদনাদিতে দুঃখী না থেকে সন্তুষ্ট থাকে সেই বংশের নিশ্চিতভাবে শ্রীবৃদ্ধি হয়। 

ভগিনী, পত্নী, পুত্রবধু প্রভৃতি স্ত্রীরা অনাদৃত হয়ে যে বংশকে উদ্দেশ্য করে অভিশাপ দেন, সেই বংশ অভিচার হতের মত ধনপশু প্রভৃতির সহিত সর্বতোভাবে বিনাশ প্রাপ্ত হয়। 

অতএব যারা ভূতি অর্থাৎ ঐশ্বর্য্য সম্পদাদি কামনা করেন, এইরকম পতিসম্বন্ধীয় লোকেরা উপনয়ন, অন্নপ্রাশন প্রভৃতি বিভিন্ন সৎকার্য্যানুষ্ঠানে এবং নানা উৎসবে অলঙ্কার, বস্ত্র ও ভোজনাদির দ্বারা নিত্য নারীদের পূজা করবে; অর্থাৎ সম্মানিত করবে।"


কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 

সহকারী অধ্যাপক, 

সংস্কৃত বিভাগ, 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url

আপনাদের ক্লিক এই Website টি সচল রাখার অর্থ যোগাবে।