Translate

সংখ্যালঘু ও মাৎস্যন্যায়ের অসম দৌড় | Shri Kushal Baran Chakraborty

সংখ্যালঘু ও মাৎস্যন্যায়ের অসম দৌড় Shri Kushal Baran Chakraborty,বৃহত্তর নিষ্ঠুরতার ফাঁদ, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সুরক্ষায় বিশেষ সুযোগ সুবিধা কিছুই নেই,sojasapta2

আমার যতদূর মনে পড়ে, 'সংখ্যালঘু' শব্দটি সংখ্যালঘুদের ব্যবহার না করতে প্রথম প্রচারণা শুরু করে বাংলাদেশের দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত নেতৃবৃন্দরা। তারাই সর্বপ্রথম প্রচারণা শুরু করে যে,"আপনারা কেউ নিজেকে সংখ্যালঘু বলবেন না,নিজেকে কেউ ছোট ভাববেন না, আমরা আমরা সবাই সমান, আমরা সবাই বাংলাদেশী।" কথাটা শুনতে খুব সুন্দর শোনায়।আসলেই খুবই সুন্দর বাক্যটা।একটা সুন্দর যুগের জন্য, সুন্দর কালের জন্য কথাগুলো প্রযোজ্য। কিন্তু এই কথাটার মধ্যে যে একটা বৃহত্তর নিষ্ঠুরতার ফাঁদ আছে, সেই ফাঁদটা আমরা অনেকেই আপাতদৃষ্টিতে বুঝতে পারি না। বিষয়টা অনেকটা বাঙালির মিছরির ছুরি প্রবাদবাক্যের মত। যেখানে সুস্বাদু মিছরি ছুরি হয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত  অনিষ্ট করে দেয়। 


একটা পুকুরে অসংখ্য ছোট ছোট মাছ আছে। সাথে আছে বড় বড় রুই, কাতল,বোয়াল মাছ। আমরা যখন সেই পুকুরে মাছ চাষ করি, তখন ছোট্ট মাছগুলোকে আগে কিছুটা বড় হতে দিয়ে এরপরে পুকুরের বড় মাছগুলোর সাথে একসাথে মিলতে দেই। পুকুরে মাছগুলোর যদি ছোট্ট অবস্থাতে ছোটমাছ, বড়মাছ মিলিয়ে ছেড়ে দেই ; তবে বড় মাছগুলো মনের আনন্দে ছোট মাছগুলোকে খেয়ে নিঃশেষ করে দিবে। এ বিষয়টি পাল রাজাদের অনুশাসনে 'মাৎস্যন্যায়' বলে অভিহিত করা হয়েছে। মহাভারতেও অরাজক এ বিষয়টি সম্পর্কে বলে, রাজাকে সেই পরিস্থিতি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করতে বলা হয়েছে। 


রাজা চেন্ন ভবেল্লোকে পৃথিব্যাং দণ্ডধারকঃ।
জলে মৎস্যানিবাভক্ষন্ দুর্বলান্ বলবত্তরাঃ॥
অরাজকাঃ প্রজাঃ পূৰ্বং বিনেশুরিতি নঃ শ্রুতম্।
পরস্পরং ভক্ষয়ন্তো মৎস্যা ইব জলে কৃশান্।
সমেত্য তাস্ততশ্চক্রুঃ সময়ানিতি নঃ শ্রুতম্॥
(মহাভারত: শান্তিপর্ব, ৬৫.১৬-১৭)

"রাজা যদি পৃথিবীতে লােকের দণ্ড প্রদান না করতেন, তবে জলে বড় বড় মাছ যেমন দুর্বল ছোট মাছকে অবলীলায় খেয়ে ফেলে; তেমনি প্রবল বলশালী লােকেরা দুর্বল লােকদিগকে সমূলে বিনাশ করে ফেলত। বড় বড় মাছ যেমন জলের মধ্যে অপেক্ষাকৃত দুৰ্বল মাছদেরকে সুযোগ বুঝে খেয়ে ফেলে, সেরূপ শোনা যায় পূর্বকালে অরাজক পরিস্থিতিতে মানুষেরা পরস্পর পরস্পরকে সংহার করে, সকলেই বিনষ্ট হয়েছিল। এরপরে শোনা যায়, সেই মানুষেরা সকলে মিলিত হয়ে, সকলকে রক্ষার্থে কতগুলো নিয়ম প্রবর্তন করেছিল।"


মহাভারতের শান্তি পর্বে রাজনীতি এবং দেশ শাসনের প্রায় সকল কর্ম পরিকল্পনার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সেখানে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে সুশাসনের কথা, প্রজাহিতৈষী সুশাসক রাজার কথা এবং প্রজাদের নিরাপত্তা এবং বিবিধ অধিকারের কথা। অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রজাদের কি করে বিশেষ সুবিধা দিয়ে, তাদের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে তাও সুস্পষ্টভাবে মহাভারতে বলা হয়েছে। ছোট মাছেদের যেমন বড় মাছেরা সুযোগ পেলেও খেয়ে ফেলে, তাই বড় মাছদের হাত থেকে সর্বদা ছোট মাছেদের আলাদা করে রক্ষা করা অত্যন্ত প্রয়োজন। তা না হলে ছোট মাছেদের পর্যায়ক্রমে জলাধার থেকে নির্বংশ হয়ে যায়। থাকে শুধুই বড় মাছেরা। তেমনিভাবে দেশের সংখ্যালঘুদের বিবিধ সুযোগ সুবিধা দিয়ে একটু এগিয়ে নিতে সাহায্য করতে হয়। এ 'মাৎস্যন্যায়' বিষয়টি প্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বব্যাপী চলে আসছে। বেদেও বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে। মনু এবং মৎস্য অবতারের কাহিনী বর্ণনা প্রসঙ্গে 'মাৎস্যন্যায়' বিষয়টির অবতারণা করা হয়েছে। যতক্ষণই ছোট মাছগুলো আকৃতিতে ছোট থাকে, ততক্ষণই বহুবিধ বিপদ। কারণ স্বজাতি হলেও বড় মৎস্যই ছোট মৎস্যকে খেয়ে থাকে। তাই ছোট মৎস্যটিকে প্রথমে আলাদাভাবে কলসিতে পালন করে, এরপরে যেখন সেই মৎস্যটি কিছুটা বড় হয়ে কলসিকে ছাড়িয়ে যাবে তখন খাল বা সমুদ্র সহ কোন বড় জলাধারে মৎস্যটিকে ছেড়ে দিতে হবে। 


স হােবাচ। যাবদ্বৈ ক্ষুল্লকা ভবামাে বহ্বী বৈ নস্তাবন্নাষ্ট্রা ভবত্যুত মৎস্য এব মৎস্যং গিলতি কুম্ভ্যাং মাগ্রে বিভরাসি স যদা তামতিবর্ধাs অথ কর্ষুং খাত্বা তস্যাং মাং বিভরাসি স যদা তামতিবর্ধাsঅথ মা সমুদ্রমভ্যবহরাসি
তৰ্হি বা অতিনাষ্ট্রো ভবিতাশ্মীতি৷৷ 
(শতপথব্রাহ্মণ: মাধ্যন্দিন, ১.৮.১.৩)

"মৎস্যটি বললো, যতক্ষণ আমরা ক্ষুদ্র থাকি ততক্ষণই আমাদের বহুবিধ বিপদ হয়, এমনকি মৎস্যই মৎস্যকে গিলে ফেলে। অতএব আমাকে প্রথমে কলসীতে আলাদাভাবে পালন কর। যখন আমি কিছুটা বড় হয়ে সেই কলসিকে ছাড়িয়ে বড় হয়ে উঠব, তখন একটি খাল খনন করে আমাকে সেখানে পােষণ করবে। এরপরে যখন সেই খালকেও ছাড়িয়ে অনেক বড় হব, তখন আমাকে সমুদ্রে নিয়ে যাবে।এভবেই আমি বিপদকে অতিক্রম করে বেঁচে যেতে পারবাে।”



বাংলায় সার্বভৌম সম্রাট শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে, বাংলার ইতিহাসে এমনি এক মাৎস্যন্যায় অবস্থার সম্মুখীন হয়। ইতিহাসের ছাত্রমাত্রই বিষয়টি জানেন। বাংলার ইতিহাসে মাৎস্যন্যায়ের সময়টি ছিল, মোটামুটিভাবে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যকার প্রায় একশো বছর। ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে গৌড়বঙ্গে স্বাধীন, সার্বভৌম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছিলেন সম্রাট শশাঙ্ক। তিনিই প্রথম বাংলার বিভিন্ন জনপথকে একত্রিত করে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। তাই তাঁকে বাংলার প্রথম স্বাধীন সার্বভৌম সম্রাট বলা হয়। তিনি তাঁর রাজধানী স্থাপন করেছিলেন কর্ণসুবর্ণে। সম্রাট শশাঙ্কের রাজত্বকালে গৌড়ের সীমা বৃদ্ধি পেয়েছিল মগধ এবং উড়িষ্যার উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত। মহাযান বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের 'আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প' গ্রন্থের বিবরণ অনুযায়ী, ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর আগে শশাঙ্ক রাজ্য শাসন করেছিলেন প্রায় সতেরো বছর। তিনি ছিলেন একজন শক্তিশালী সার্বভৌম সম্রাট। সম্রাট শশাঙ্কের হাত ধরেই উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে গৌড়বঙ্গ।তবে দুঃখজনকভাবে, তাঁর মৃত্যুর পরে যোগ্য উত্তরসুরীর অভাবসহ নানা কারণে বাংলার আকাশে নেমে আসে এক চরম বিশৃঙ্খলা, ঘোর অন্ধকার। এ অভাবনীয় বিশৃঙ্খলতাময় যুগকেই 'মাৎস্যন্যায়' বলে।



ছোট মাছগুলোকে বড় মাছগুলো খাবে এটা পরিবেশের নিয়ম,জগতের নিয়ম। বিষয়টি শুধু মাছ নয়, মানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই বড়রা যাতে ছোটদের খেয়ে নিঃশেষ করে দিতে না পারে তাই, ছোটদের রক্ষার্থে বিশেষ সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। ছোট মাছগুলোকে বিশেষভাবে সুরক্ষা দিয়ে বড় করে তোলা হয়।ঠিক একইভাবে সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং অস্তিত্ব রক্ষার্থে বিশেষ সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। এ সুরক্ষার অংশ হিসেবে পৃথিবীব্যাপী প্রায় সমস্ত দেশে সংখ্যালঘুদের বিশেষ কিছু সুযোগ সুবিধা আছে। 


এর মধ্যে অন্যতম হল সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়। বহুদেশে সংখ্যালঘুদের কোটা সহ বিভিন্ন রকমের বিশেষ সুবিধা আছে। যাতে সংখ্যালঘুরা নিরাপদে সম্মানের সাথে দেশে থাকতে পারে। বাংলাদেশ একটা সাংবিধানিক অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হওয়ার পরেও, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সুরক্ষায় বিশেষ সুযোগ সুবিধা কিছুই নেই। অবশ্য পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চুক্তির পরে পাহাড়ি আদিবাসীদের জন্যে মন্ত্রণালয় সহ বেশকিছু সুযোগ সুবিধা আছে। কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের জন্যে এর কিছুই নেই। এর কারণ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের নেতৃত্বের দুর্বলতা এবং নিজেদের অধিকার আদায়ের বিষয়ে প্রচণ্ড ধরণের অজ্ঞতা।



রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'গীতবিতান' গ্রন্থে একটি বিখ্যাত সংগীতে রয়েছে। সেই সংগীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, যদি আমরা রাজার সাথে মিলতে চাই তবে আগে রাজার সমপর্যায়ভূক্ত হতে হবে। তা না হলে আমরা রাজার সাথে কোনদিনও মিলতে পারবো না। স্বাধীনভাবে যদি আমরা কোন কাজ করতে না পারি, স্বাধীনভাবে চলতে না পারি, তবে রাজার সাথে কখনই মিলতে পারবো না। রাজা যদি সবাইকে মান দিয়ে সমপর্যায়ে নিয়ে আসেন, তবে সেই মান-সম্মান রাজা নিজেও আরও বেশি পরিমাণে ফিরে পাবেন। অসত্য দ্বারা কাউকে খাটো ক'রে রাখলে, দাসত্ব করে রাখলে রাজার সাথে মিলিত হওয়া অসম্ভব। স্বাধীনভাবে আপন মতে এবং পথে চলতে পারলে, তবেই আর কারো বিফলতার আবর্তে পরতে হবে না। 


"আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে-
 নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?।
আমরা যা খুশি তাই করি,  তবু  তাঁর খুশিতেই চরি,
আমরা নই বাঁধা নই দাসের রাজার ত্রাসের দাসত্বে-
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?।
রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান,
মোদের খাটো ক'রে রাখে নি কেউ কোনো অসত্যে-
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?
আমরা চলব আপন মতে, শেষে মিলব তাঁরি পথে,
মোরা মরব না কেউ বিফলতার বিষম আবর্তে-
 নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?।"


কারো সাথে সত্যিকার অর্থে মিলতে হলে, আগে তার সমপর্যায়ভূক্ত হতে হবে। কারণ ব্যতিক্রমী দুইএকটা ঘটনা ছাড়া দুর্বলে এবং সবলে কখনো প্রকৃত বন্ধুত্ব হয় না। যদি আপাতদৃষ্টিতে বন্ধুত্ব হয়, তবে বুঝতে হবে যে- সবল দুর্বলের প্রতি করুণা করছে। দুটি কাধ যদি সমান না হয় তবে মাথা কখনও সোজা থাকে না। মাথাকে সমান রাখতে হলে, দুটি কাধকে আগে সমান রাখতে হবে। তেমনি একটি রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সংখ্যালঘিষ্ঠদের সমান অধিকার সুযোগ সুবিধা না থাকে, তবে রাষ্ট্রযন্ত্রও মাথা উঁচু করে থাকতে পারে না। মাথা ঝুকে নিচু হয়ে যায়। যা সকলের জন্য অকল্যাণকর। 


কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 
সহকারী অধ্যাপক, 
সংস্কৃত বিভাগ, 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url

আপনাদের ক্লিক এই Website টি সচল রাখার অর্থ যোগাবে।