ওআইসি বা ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (OIC- Organisation of Islamic Cooperation)
ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা বা সংক্ষেপে ওআইসি একটি আন্তর্জাতিক ইসলামি সংস্থা। পূর্বে সংস্থাটির নাম ছিল ইসলামি সম্মেলন সংস্থা। ১৯৬৯ সালে গঠিত সংস্থাটিতে ৫৭টি দেশ প্রতিনিধিত্ব করছে যার মধ্যে ৪৯টি মুসলমান প্রধান দেশ।
১৯৬৭ সালের ছয়দিনের যুদ্ধের পর ১৯৬৯ সালের ২১ আগস্ট ইসরাইল জেরুজালেমের মসজিদুল আকসায় অগ্নিসংযোগ করে। এর ফলে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে প্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ায় ২৫ আগস্ট ১৪টি আরব দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণ মিশরের রাজধানী কায়রোতে এক বৈঠকে মিলিত হয়।
সৌদি আরব প্রস্তাব করে,
যেহেতু বিষয়টি মুসলিম বিশ্বের জন্য স্পর্শকাতর তাই সকল মুসলিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে নিয়েই শীর্ষ বৈঠক আয়োজন করবে। মরক্কো, সৌদি আরব, ইরান, পাকিস্তান, সোমালিয়া, মালয়েশিয়া এবং নাইজারকে নিয়ে প্রস্তুতি কমিটি গঠিত হয়। একই বছরেরই ২২-২৫ সেপ্টেম্বর মরক্কোর রাবাতে ২৫টি মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানদের নিয়ে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিগণের সিদ্ধান্তক্রমে ইসলামি সম্মেলন সংস্থা নামে এই প্রতিষ্ঠানটি আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৬৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ওআইসি প্রতিষ্ঠিত হয়। মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর পশ্চিম আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, এবং ভারতীয় উপমহাদেশের ৫৭টি ইসলামি রাষ্ট্র নিয়ে এই সংস্থা গঠিত।
২০১১ সালের ২৮ জুন আস্তানা, কাজাখস্তানে অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের কাউন্সিলে প্রতিষ্ঠানটির নাম ইসলামি সম্মেলন সংস্থা পরিবর্তন করে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা করা হয়। এই সময়ে ওআইসির লোগোও পরিবর্তন করা হয়।
সংস্থাটির মতে তারা,
‘মুসলিম বিশ্বের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর’ হিসেবে এবং ‘আন্তর্জাতিক শান্তি ও সম্প্রীতি প্রচারের চেতনা নিয়ে মুসলিম বিশ্বের স্বার্থ ধারণ ও সুরক্ষায়’ কাজ করে থাকে।
তাদের নীতিবাক্য,
"মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা ও অগ্রগতি ও মঙ্গল নিশ্চিতকরণ"
১৯৭৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ওআইসির সম্মেলনে সদস্য পদ লাভ করে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মহিউদ্দিন আহমদ বলেন,
১৯৬৯ সালের ২২-২৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত মুসলমানপ্রধান দেশের একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনটির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল- এখানে ভারতকে সদস্য হতে দেয়া হয়নি। ভারতের পক্ষে তখন ভারতের এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, পরে দেশটির প্রেসিডেন্ট, ফকরুদ্দিন আলী আহমদ প্রথম দিকে শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থিত থাকলেও পরে আর তাকে থাকতে দেয়া হয়নি। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এবং সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের তীব্র প্রতিবাদে ফকরুদ্দিন আলী আহমদ শীর্ষ সম্মেলনে আর উপস্থিত থাকতে পারেননি। তখন হিন্দুপ্রধান দেশ হলেও মুসলমান জনসংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় দেশ ছিল ভারত।
বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পাকিস্তানের লাহোরে ১৯৭৪-এর ২২-২৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ওআইসির দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলনে সদস্য হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেয়। আমাদের বাংলাদেশের জন্য লাহোর শীর্ষ সম্মেলনটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। বঙ্গবন্ধু দৃঢ়ভাবে ঘোষণা দেন যে, পাকিস্তান আগে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি না দিলে তিনি লাহোর যেতে পারেন না, যাবেন না। প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর ওপর ওআইসিভুক্ত দেশগুলো থেকেও প্রচণ্ড চাপ পড়ে। ভুট্টো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার পর কয়েকজন ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুকে সসম্মানে তাদের প্লেনে করেই লাহোর নিয়ে যান। বঙ্গবন্ধুকে লাহোর বিমানবন্দরে যথাযথ অভ্যর্থনা জানানো হয়, মর্যাদা ও গুরুত্ব দেয়া হয়। (ওআইসি নিয়ে কিছু স্মৃতিকথা, ০৭ মে ২০১৮, যুগান্তর)
১৯৭৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে আয়োজিত ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সম্মেলনে সমকালীন মুসলিম বিশ্বের সমস্যা এবং সম্ভাবনা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু এক যুগান্তকারী বক্তব্য দেন।
ফিলিস্তিনসহ নির্যাতিত মুসলমানদের অধিকার নিয়ে এ ভাষণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- আজকের আধুনিক মুসলিম নেতারা ইসলামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ফিরিয়ে আনার জন্য যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছেন বা চিন্তা করছেন, বঙ্গবন্ধু আরও আগেই এসব কথা বলে গেছেন। এ থেকে একটি বিষয় অত্যন্ত পরিষ্কারভাবেই ফুটে ওঠে যে, বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের মুসলমানদের উন্নয়নের কথাই ভাবতেন না, বরং বিশ্ব মুসলমানের ঐক্য এবং ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে দেখার স্বপ্নও বুকে লালন করতেন।
বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষে ওআইসিতে দেয়া তার ঐতিহাসিক ভাষণটি পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হল।
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের এখানে সমবেত ভাইদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ ও আরব ভাইদের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামে তাদের সমর্থন ঘোষণার জন্য এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে পারায় আমরা খুবই আনন্দিত। সেক্রেটারি জেনারেলসহ অন্য যারা আমাদের ভাইদের পার্শ্বে আজ আমাদের উপস্থিতির আয়োজন করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন, আমি তাদের সবার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। যে মহামান্য নেতারা আজ আমাদের স্বাগত জানিয়েছেন আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই।
আর ধন্যবাদ জানাই আমাদের মেজবান ও সম্মেলনের চেয়ারম্যান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে। আমি বলতে চাই, সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায় উন্মোচিত হয়েছে। আমরা এ উপমহাদেশে এবং বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যুগপৎ অবদান রাখার পথ উন্মুক্ত করেছি।
আজকের মতো মানবজাতি ইতোপূর্বে কখনও এত বড় কঠোর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়নি। একদিকে ভয়াবহ বিপদ আর অপরদিকে জীবনের মানোন্নয়ন সৃজনশীল বিপুল সম্ভাবনা- বিশ্বের মানুষ ইতঃপূর্বে এমন পরিস্থিতির দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়নি। মানুষ এখন বস্তুগত দিক থেকে বৃহত্তর শক্তি অর্জন করেছে যা সে আর কখনও করতে পারেনি। সে পৃথিবীকে ধ্বংস করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। আমরা যুদ্ধের জন্য শক্তি অপব্যবহার করতে দেখেছি, জনগণকে নিপীড়ন করতে দেখেছি।
আমরা তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার অস্বীকার করতে দেখেছি। অকথ্য দুর্ভোগের মাঝে তাদের ঠেলে দিতেও আমরা দেখেছি। আর এসব অবর্ণনীয় যাতনার চূড়ান্ত নিদর্শন হয়ে আছেন আমাদের ফিলিস্তিনি ভাইয়েরা। আর এ জন্যই অতীতের তুলনায় আজ এ শক্তিকে প্রজ্ঞার সঙ্গে কাজে লাগানোর প্রয়োজন বেশি।
ধ্বংস নয় সৃষ্টি, যুদ্ধ নয় শান্তি, দুর্ভোগ নয়, মানুষের কল্যাণে আমাদের কাজ করতে হবে। আমরা যদি মহানবীর প্রচারিত মানবপ্রেম ও মর্যাদার শাশ্বত মূল্যবোধ আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পারি তাহলে বর্তমানকালের সমস্যা সমাধানে মুসলিম জনসাধারণ সুস্পষ্ট অবদান রাখতে সক্ষম হবে। এসব মূল্যবোধে উজ্জীবিত হয়ে শান্তি ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে আমরা একটি নতুন আন্তর্জাতিক ঐতিহ্য গড়ে তুলতে পারি। এ সম্মেলন শুধু আরব ভাইদের সংগ্রামের প্রতি সমর্থনে আমাদের ঐক্য সংহত করার জন্যই নয়, বরং জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর সঙ্গে বিশ্বব্যাপী শান্তি ও প্রগতিশীল শক্তিগুলোর সঙ্গে আমাদের একাত্মতা ঘোষণার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদ ও সব ধরনের শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের সঙ্গে একাত্মতার ওপর জোর দিতে হবে। আমাদের ভাইদের ওপর যে নিদারুণ অবিচার হয়েছে অবশ্যই তার অবসান ঘটাতে হবে। অন্যায়ভাবে দখলকৃত আরব ভূখণ্ড অবশ্যই ছেড়ে দিতে হবে। আমাদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে জেরুজালেমের ওপর। রমজান যুদ্ধের অকুতোভয় বীর শহীদানের প্রতি আমরা সালাম জানাই।
তারা তাহাদের শৌর্য ও আত্মত্যাগের দ্বারা বহু অমূলক ধারণা ধূলিসাৎ করে এমন একটি নতুন কার্যকর অবস্থার সৃষ্টি করেছেন যাতে এ কথাই মূর্ত হয়ে উঠেছে যে, ন্যায়বিচার ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বিজয় অবধারিত। আমরা পুরোপুরিরূপে বিশ্বাস করি, ইতিহাস একটি ক্রান্তিলগ্নে এসে পৌঁছেছে। আমরা আমাদের সম্মিলিত ও সুচিন্তিত কার্যক্রম দিয়ে আমাদের ভাইদের ওপর চালিত অবিচারের অবসান ঘটাতে পারব।
আল্লাহর কৃপায় আমরা এখন আমাদের সম্পদ ও শক্তি এমনভাবে সংহত করতে পারি, যাতে আমাদের সবার জন্য শান্তি ও ন্যায়বিচার অর্জন করা যায়। এ সাফল্য অর্জনের জন্য বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ সম্ভাব্য সব ধরনের সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদের সব যুক্ত প্রচেষ্টা সফল করুন। ধন্যবাদ, জনাব চেয়ারম্যান। (ওআইসি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ১৪ আগস্ট ২০২০, যুগান্তর)