Translate

মানবজীবনে গরুর উপকারিতা ও সনাতনধর্মে গরু কেন পূজনীয় | গরুর রচনা বাংলা

মানবজীবনে গরুর উপকারিতা ও সনাতনধর্মে গরু কেন পূজনীয়
মানবজীবনে গরুর উপকারিতা ও সনাতনধর্মে গরু কেন পূজনীয়

গ্রাম বাংলায় প্রতিটি বাড়িতে কেনো গরু পালন করত?

এমন একটা সময় ছিলো যখন এদেশের প্রতিটি অঞ্চলে তথা গ্রাম বাংলার কোন পরিবারই গরুহীন ছিলো না। প্রায় প্রতিটি পরিবারের এক বা একাধিক গরু এবং গরু রাখার গরুঘর, বাড়ী সামনে বা পেছনে খড়ের চিন শোভা পেত। সম্ভবতঃ বছর ত্রিশ কিংবা পঁয়ত্রিশেক আগেও কম বেশী এধরনের অবস্হা দেখা যেত। আজ আর সে রকম দেখা যায় না। 

তবে সমাজের প্রতিটি পরিবারে গরু গুলোর মধ্যে গ্রামের হিন্দু পরিবারের গরুগুলি অধিক যত্ন আত্তি পেত। যত্ন বললে ভুল হবে, বলা যায় নিয়মিত পূজা পেত। আমি আমার মা ঠাকুমাকে দেখতাম প্রতিদিন সন্ধ্যায় গরুর পা শুদ্ধ জল ধুঁইয়ে দিতে, গরুর গায়ে ও ঘরে ধূপ দিতে গরুকে প্রনাম করতে। এছাড়াও বিশেষ বিশেষ দিনে গরুর পা ধুইয়ে কপালে সিঁদুরের ফোঁটা ও গায়ে চালের গুঁড়োর ছাপ দেয়া হতো। নতুন ধানের চাল গুঁড়োর পিঠা বানিয়ে গরুকে খাওয়ানো হতো এবং নিজেদেরও খাওয়া হতো। হিন্দুবাড়ীতে নতুন গরু কিনে আনার পর পা ধুইয়ে সিঁদুরের ফোটা দেওয়া হত। 

চৈত্র সংক্রান্তিতে গরুকে কিভাবে আপ্যায়ন করা হতো?

চৈত্র সংক্রান্তিতে পরিবারের বাচ্চাদের নতুন জামা কাগড়ের সাথে গরুর জন্য কেনা কিংবা তৈরী করা হতো নতুন দঁড়ি। এভাবে গরুর প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো হত বলেই হিন্দুরা বংশ পরম্পরা কখনো গরুর গায়ে পা লাগায় না। এছাড়াও হিন্দু পরিবারে নতুন মানব শিশু আগমনের পর ছয় দিনের যেমন যষ্ঠীর অনুষ্ঠান করা হয়, তেমনি গাভীর বাচ্চা প্রসবের তের অথবা একুশ দিনে ত্রিনাথের মেলা নামে একটি অনুষ্ঠান করা হত এবং এর আগে গাভীর দুগ্ধ দোহন করা হত না। আমরা ছোটরা দেখতাম মা-ঠাকুরমাগন সবার আগে অতিভোরে ঘুম থেকে উঠে গরুর ঘরের দিকে যেতেন এবং গরুর গোবর ঘটিতে নিয়ে জলের মিশ্রনে ঘরের আসপাশ ও আঙ্গিনায় ছড়িয়ে দেযার পর ঝাঁড়ু দিতে। গ্রামের মা ঠাকুর মা গন মূলতঃ এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ঘরের অন্যান্য গৃহ দেবতা বা দেবীর পাশাপাশি গো-ব্রাহ্মন, গো-মাতার সেবা করে আসতে।

হিন্দু সমাজে গরু নিয়ে আরও তথ্য

আজকাল গ্রামের বাড়ী গুলোতে তেমন গরু রাখা হয় না। তথাপি হিন্দু পরিবার গুলি গরুর প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান, পূর্জন এখনো অবধি অতটুকু কমেছে বলে মনে হয় না। হিন্দুদের প্রায় প্রতিটি নিত্যকর্ম, বেদোক্তমতে শিশুর জম্নে, যৌবনে বিবাহে কিংবা মৃতের আদ্যশ্রাদ্ধ্য ও সপিন্ডকরণে গরু ও গরু হতে উৎপন্ন পঞ্চগভ্যের প্রয়োজন হয়। 

পঞ্চগভ্য কাকে বলে ও এর  উপকার কি?

গরুর থেকে উৎপন্ন হয় দই, ক্ষীর, ঘি, গোমুত্র ও গোবর – এ পাঁচটি পদার্থকে বলা হয় পঞ্চগভ্য। হিন্দু সম্প্রদায়ের কোন কোন পূজায় পঞ্চগভ্য অপরিহায্য ভাবে ব্যবহার হয়। এর ভিত্তি হলো গোবর ও গোচনার প্রয়োগের মাধ্যমে পূজো বা যজ্ঞের স্হান বা পরিবেশ ব্যাকটেয়িরা মুক্ত রাখা, পূজোয় ভোগে দই, ক্ষীর, ঘি উপাচার হিসাবে প্রয়োগ করার মাধ্যমে অন্য সব উপচারের পুষ্টিমান ধরে রাখা, সর্বোপরি পুঁজোর প্রসাদকে অধিক নিরাপদ, পুষ্টিগুন সমৃদ্ধকরা ও স্বাস্হ্য সম্মত রাখা। আয়ূর্ৱেদিক ঔষধি মতে এই পঞ্চগভ্য স্বাস্হ্য সুরক্ষায় ও পরিবেশ রক্ষায় অত্যন্ত উপকারি। একারণে সনাতনী সংস্কৃতিতে (১) গরু, (২) সংস্কৃত ভাষা (দেবভাষা) ও গীতা – এতিনটি সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ স্হান দখল করে আছে। বলা হয়ে থাকে ভগবান বিষ্ঞর বাহন গোমাতা (গাভী)। অন্যদিকে শিবের বাহন বৃষ (ষাড়), মূলতঃ একারণেই গরুকে সম্মানের চোখে দেখা হয়। শাস্ত্রীয় মতে দুগ্ধবতী গাভীকে মনে করা হয় **‘মাতরঃ সর্বভূতানাং গাবঃ সর্বসুখপ্রদাঃ’ অর্থাৎ সর্বভূতের মাতা বলে। চৈতন্যদেব গরু বিষয় বলেছেন – **‘গো দুগ্ধ খাও তাই গাভী তব মাতা। বৃষ অন্ন উপজায় তাহে তেহ পিতা’।

গরুকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য ধর্মগ্রন্থে কি কি উল্লেখ আছে?

হিন্দুধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বহু মত পথ, শাখা, উপশাখা ও সম্প্রদায় বিভক্ত থাকলেও কেহই গোজাতির মহত্ত্ব ও পবিত্রতার বিষয়ে অস্বীকার করেনা। “বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, স্মৃতি সকল শাস্ত্রে গোজাতির প্রতি অসাধারণ সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে। বৃহৎপরাশর স্মৃতিতে গোজাতির মহত্ত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে – গরুকে স্পর্শ করলে পাপ দূর হয়, গরুর সেবা করলে বিত্তলাভ হয়, গোদান করলে স্বর্গলাভ হয়; গরুর মস্তকে ব্রহ্মা, স্কন্ধে শিব, পৃষ্ঠে নারায়ণ এবং চরণে বেদসমূহ অবস্থান করেন। গাভীর লোমে অন্যান্য দেবতারা অবস্থান করেন। গরু সর্বদেবময় এবং গরুর প্রতি ভক্তি করলে হরি তুষ্ট হন। তাই গরুর সেবা করলে সকল দেবতা তুষ্ট হন। গরু অষ্টমঙ্গলের অন্যতম (অষ্টমঙ্গল: ব্রাহ্মণ, গরু, অগ্নি, স্বর্ণ, ঘৃত, সূর্য, জল, রাজা)। গরুকে দর্শন, নমস্কার, অর্চনা ও প্রদক্ষিণ করলে আয়ু বৃদ্ধি হয়। ব্রহ্মপুরাণে বলা হয়েছে, গাভীকে প্রদক্ষিণ করলে সপ্তদ্বীপা পৃথিবী ভ্রমণের ফল হয়। বিষ্ঞু পুরাণ মতে গরুর মল, মূত্র, ক্ষীর, ঘৃত, দধি ও রোচনা পরম পবিত্র ও বহুগুণযুক্ত”।

রাজা-মহারাজারা কেনো গরু পালন করত?

অতি সুপ্রাচীনকাল হতে ভারতবর্ষের অনেক রাজা-মহারাজার গোপালন করতেন। মহাভারতে বর্ণিত, বিরাট রাজার ষাট হাজার গাভী ছিল। কে কত বেশী ধনশালী ও সমৃদ্ধশালী তা ঐ রাজ্যের গোশালা ও গরুর সংখ্যার উপর নির্ভর করতো। অতীতে রাজা-মহারাজারা যে দান-ধ্যান করতেন, তার একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল গোদান। গো-দানকে এখনো অবধি হিন্দু সমাজে বিশেষ পুণ্যকাজ বলে মনে করা হয়।

খুব মনে আছে, ছোট বেলায় বাড়ীর মা, ঠাকুরমাগন খুব ভোরে ঘুম থেকে গরু ঘরের গোবর ঘটিতে নিয়ে পরিস্কার জলে গুলে তা বাড়ী আঙ্গিনায় ছিটাতেন, পূজো কিংবা সন্ধ্যা আহ্নিকের জায়গা গোবর মিশানো জল ছিটানো কিংবা ঘরের ভিটি লেপন করতেন, তা দেখে প্রতিবেশী অন্যধর্মাবলম্বী বন্ধুরা ঠাট্টা মশকরা করতো এবং তাদের ঠাট্টা মশকরায় হীনমন্যতায় ভুগতাম। সহপাঠী বন্ধুরা প্রায় ক্ষেপাতো হিন্দুরা গরুর পূজো করে, দুধ খায় কিংবা মাংশ খায় না। ঐসকল বন্ধুরা দুধ খাওয়া আর মাংশ খাওয়ার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারতো না বলে খোঁছা দিত। কিন্তু শিশুকালে এর জবাব দেয়া সম্ভব ছিলো না। বড়দের জিজ্ঞেস করলে বলতঃ গাভী বিষ্ঞুর বাহন, ষাড় শিবের বাহন এবং গোজাতি হত্যা মহাপাপ। এককথায় বলতো নরহত্যার মুক্তি আছে কিন্তু গো-হত্যায় মুক্তি নেই। আজ মধ্য বয়সে এসে উপলব্দী করা সম্ভব হয়েছে কেন হিন্দু ধর্মে গুরুকে এতোটা প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, যা স্ব উপলব্দীজাত বিষয়টি নিচে উল্লেখ করছি।


পৃথিবীতে সম্ভবতঃ গো-জাতিই একমাত্র প্রাণী যা খায় ঘাষ, দেয় দুধ, মল ও মুত্র ত্যাগের মাধ্যমে প্রকৃতিতে তথা আমাদেরকে দেয় জৈব সার ও জীবানু নাশক উপাদান। সম্ভবতঃ একসঙ্গে এধরনের একাধিক উপযোগীতা পৃথিবীর অন্য কোন পশুকুলের মধ্যে দেখা যায় না। কৃষি সভ্যতার শুরু থেকে গরুই একমাত্র প্রানী যা মানুষকে কোটি কোটি বছর অবধি চাষের ভূমি কর্ষন করে সহজে অধিক ফসল ফলাতে সাহায্য করেছে। চাকা সভ্যতা শুরু হবার পর পন্য পরিবহনের কাজে সাহায্য করেছে। বলা হয়ে থাকে, গরুর দুধ মাতৃ দুগ্ধের পরিপূরক, অর্থাৎ অকালে মাতৃহীন মানব শিশুর জীবন রক্ষায় গরুর দুধের সমকক্ষ কিংবা বিকল্প আজ অবধি নেই । পৃথিবীতে যত রকম মিষ্টি জাতীয় ও সহজপাচ্য খাদ্য সামগ্রী তৈরী হয়, ঐসবক’টি খাবারের মধ্যে দুধের ব্যবহার অত্যাবশ্যক, যদি আজকাল গরুর তাজা দুধের অভাবে বিকল্প হিসাবে পাস্তুরিত দুধ ও পাউডার দুধ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

মা, ঠাকুরমায়েরা কেনো গো পালন করত তার বৈজ্ঞানিক কারন?

পূর্বে উল্লেখ্য করা হয়েছে হিন্দু পরিবারের মা, ঠাকুরমা গন প্রাত্যহিক সকালে গোবর জল ছিটিয়ে বাড়ী, ঘর ও আঙিনা পবিত্র করে। এসব মা, ঠাকুরমা গন ঘর দোর পবিত্র করণ কাজ বুঝলেও মূলতঃ আমাদের আবাসের স্হলে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া গুলো নিধন করার জন্য এসব কর্ম করে থাকেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম– যা আমাদের আর্যঋষিদের ভাবনা থেকে প্রাপ্ত ধারণা থেকে এসব মা-ঠাকুরমাগন কাজটা করতেন। যে কারণে আর্যঋষিদের সকল মতাবল্বী অনুসারীরা সকল স্তরে পশুকুলের মধ্যে গো-জাতিকে আলাদাভাবে শ্রদ্ধা, সম্মান, পূজনের জন্য।

কৃষি সভ্যতায় গরুর অবদান

ইতোপূর্বে জমির উর্ব্বরতা বৃদ্ধির জন্য গোবর দিয়ে তৈরী জৈব সার চিটিয়ে জমির উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি করা হতো। প্রাচীন কৃষি ব্যবস্হায় প্রকৃতির লতাপাতা দিয়ে তৈরী কীট নাশক ছিটিয়ে ফসল রক্ষা করা হতো। বিগত তিন থেকে চার দশক অবধি এদেশের কৃষিকাজের উর্বরতা জন্য সার ও কীট নাশক প্রয়োগ করা হচ্ছে। কৃত্রিম কীটনাশক উৎপাদিত হবার পর কীটনাশককে ফসল রক্ষাকারী উপাদান হিসেবে মনে করা হয়। অথচ আজ ল্যাবে প্রমানিত সত্য যে এই কীটনাশকই ফসল ধ্বংসকারী পদার্থ হিসেবে চিহ্নিত হতে যাচ্ছে। কৃত্রিম রাসায়নিক সার জমির উর্ব্বরতা শক্তি হ্রাস করছে। বিষয়টি নিয়ে গবেষকদের মধ্যে নতুন ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য নতুন প্রজন্মের কৃষি গবেষকরা জমির উৎপাদিকা শক্তি ও ফসলের জন্য ক্ষতিকর নয় এমন পরিবেশ বান্ধব কীটনাশক, সার তৈরীর দিকে ঝুঁককে শুরু করেছেন।


প্রাচীন কৃষি সভ্যতায় ফসলের জমিতে কীটনাশক হিসেবে নিমপাতা ব্যবহার করা হতো। গোরব ছাই ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে গবেষেকরা সেই পুরোনো কথাই পুনরায় বলছে এবং পুরোনো নির্দেশনা গুলো মেনে আধুনিক কৃষিজীবিরা ভাল ফল পাচ্ছেন। অতিসম্প্রতি শোনা যাচ্ছে, ফসলের ক্ষতিকর কীট পতঙ্গ দমনে গো-চনা প্রয়োগের কথা। জানা গেছে, বিদেশের পাশাপাশি বাংলাদেশের কৃষকরাও কৃষি জমিতে কীটনাশক হিসেবে গো-চনা (গো-মূত্র) প্রয়োগ করে কাঙ্খিত সাফল্য পাচ্ছেন। ”গবেষনা বিষয়ে বিভিন্ন নিবন্ধ থেকে জানা যায়, গো-চনা হতে তৈরি কীটনাশক এবং চনা ও গোবর বিশেষের সমন্বয়ে তৈরি ইন-সেক্টিসাইড ভালো কাজ করে কীটপতঙ্গ প্রতিরোধক্ষম হিসেবে। এ ধরনের পদার্থ পরিবেশ বান্ধব বলে জানান গবেষকরা। গো-চনা ফার্মান্টেশন করলে তা সফল ভাবে ক্ষতিকর পোকামাকড় নিবারনে কাজ দেয়। বিজ্ঞানীরা জানান, গো-চনা হতে কীটনাশক তৈরি করতে হলে প্রথমে কয়েকটি গরু থেকে সংগ্রহ করতে হবে মূত্র বা চনা। তা একসঙ্গে মিশিয়ে ১৮-২০ দিন পুঁতে রাখতে হবে মাটির নীচে। তারপর এতে মেশাতে হবে নির্দিষ্ট পরিমাণ বা মাত্রার সিতাফল, নিম, পাইথন নামক গাছের নির্দিষ্ট মাত্রার নির্যাস। এই মিশ্রণ ফসলের ক্ষেতে প্রয়োগ বা স্প্রে করতে হবে শতকরা ২৫-৩০ ভাগ ঘনমাত্রায়। ওই গাছ বা উদ্ভিদের সঙ্গে গরুর মূত্রের বিকর্ষক কর্মকান্ড ঘটলে তা দ্রুত ফল পাওয়া যাবে বলে বিজ্ঞানীরা জানান। ফার্মান্টেশনের জন্য পাঁচ-ছয় লিটার গরুর মূত্র, সম ওজনের গোবর এবং সম ওজনের পানি একত্রে সুন্দরভাবে মিশিয়ে তা প্লাস্টিকের পাত্রের মধ্যে রাখতে হবে ৪-৫ দিন। তবে পাত্রের ঢাকনা বা ছিপি এমনভাবে লাগাতে হবে যাতে বাতাস প্রবেশ করতে না পারে এর ভেতর। তারপরের কাজ হলো মুক্ত অ্যাসিড এবং ফেলনকে (বিষাক্ত) নিরপেক্ষ করা। এজন্য এতে প্রয়োগ বা যোগ করতে হবে প্রায় ১০০ গ্রাম চুন বা লাইম। পরে এর দ্রবণ তৈরি করতে হবে ৮৫-৮৫ লিটার পানির সঙ্গে। তারপর তা স্প্রে করতে হবে প্রায় এক একর জমিতে। অর্থাৎ একর প্রতি জমিতে এই পরিমাণে তা লাগে বলা যায়”।


এরই মধ্যে গরুর মূত্র বা গো-চনা প্রয়োগ করে অনেক দেশের কৃষকরা আঙ্গুরের ছত্রাকজনিত রোগ, ট্রবেরির ব্লোসম উইভিল, উঁইপোকাসহ নানা ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ধ্বংস ও রোগ নিরাময়ে ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন। এতে ভাল ফল পাওয়া যায় শাক-সবজি, ফল জাতীয় বৃক্ষ ও দানাজাতীয় ফসলের ক্ষেত্রে। জানা যায়, সুইডেনে স্ট্রবেরির ফলন ব্লোসম উইভিলের আক্রমণ হতে প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ হ্রাস পায় এর কারণে। সেখানে কৃষি জমিতে প্রয়োগ করা হচ্ছে গো-চনার সঙ্গে অন্যান্য জিনিসের মিশ্রণ। তাতে ভালোই ফল পাচ্ছেন কৃষকরা। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গো-মূত্র কৃষিতে একদিন না একদিন বিপ্লব ঘটাবে। গো-চনা পাওয়া যায় সহজেই। তবে এদেশের মূল সমস্যা হলো দেশে গরু পালন গনহারে কমে গেছে। এদেশের আজ থেকে ৩০-৩৪ বছর আগের তুলনায় বর্তমানে মাত্র ১০ ভাগ গরুও অবশিষ্ট নেই বিধায় এক্ষেত্রে বড় বাঁধা।


গরুর প্রতি হিন্দু সম্প্রদায়ের এধরনের সম্মান, শ্রদ্ধার ধর্মীয় কারণ বলা হলেও মূলতঃ এর অর্ন্তনিহিত কারণ বৈজ্ঞানিক ও প্রয়োগিক কারণ। আগেই বলা হয়েছে, হিন্দু পরিবার গুলো গোবর ও গোচনা বাড়ীর আঙ্গিনা ব্যবহার করেন পবিত্রতার কাজে, যদিও এসব হিন্দুপরিবারের মায়েরা জানেন না যে মূলত ব্যাকটেরিয়া নিধনের জন্য তারা কাজ করছেন। এটি প্রাচীন আর্যঋষিদের ভাবনা নির্দেশনা হলেও আধুনিক বিজ্ঞানে প্রমানিত সত্য হিসাবে প্রকাশ পাচ্ছে।


আধুনিক ফ্ল্যাট বাড়ী সভ্যতায় ফ্লোর, বার্থরুম পরিস্কারক হিসাবে হারফিক, ফিনাইল ব্যবহার হচ্ছে। এগুলো দ্রুত কাজ দেয় বটে, তবে পরিবেশ বান্ধব ও অধিক স্বাস্হ্য সম্মত নয় বলে খোদ উৎপাদকরাই সংশয় প্রকাশ করেন। কিন্তু কোন ক্ষতির আশংকা নেই এমন জিবানুনাশক তরল একমাত্র গোমুত্র থেকেই উৎপাদন করা সম্ভব এবং তা উৎপাদন করে রীতিমতো ব্যবহার হচ্ছে কিছু কিছু দেশে। আমাদের পাশ্ববর্তীদেশ ভারতে ইতোমধ্যে ফিনাইলের বদলে গো-মূত্র থেকে তৈরি পরিৱেশ বান্ধৱ `গানুইল’ ব্যবহারের সুপারিশ করছেন ভারতের কোন কোন মন্ত্রী। বাজে রাসয়ানিক পদার্থের তৈরী ফিনাইলের পরিবর্তে গো-মূত্রের মত প্রাকৃতিক পদার্থ দিয়ে তৈরী ‘গানুইল’ সম্পূর্ণ ‘পরিৱেশ বান্ধব।


এককথায় মানুষের খাদ্য সরবরাহের তথা কৃষিজ উৎপাদন, সুষম পুষ্টি যুক্ত খাদ্যের যোগান, সবোর্পরি প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় গো সম্পদের অবদান অপরিহার্য। মূলতঃ এসব কারণে আদি ঋষিগন গোসম্পদ নিধন করার পরিবর্তে রক্ষায় ও প্রকৃতিতে এর উত্তরোত্তর বৃদ্ধির লক্ষ্যে তাদের অনুসারীদের নানা ভাবে নিদের্শ দিয়ে গেছেন এভাবে – গরুকে স্পর্শ করলে পাপ দূর হয়, গরুর সেবা করলে বিত্তলাভ হয়, গো-দান করলে স্বর্গলাভ হয়; গরুর মস্তকে ব্রহ্মা, স্কন্ধে শিব, পৃষ্ঠে নারায়ণ এবং চরণে বেদ সমূহ অবস্থান করেন। গাভীর লোমে অন্যান্য দেবতারা অবস্থান করেন।

লেখকঃ অরুন চন্দ্র মজুমদার

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url